বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বুধবার (২৩ অক্টোবর) রাতে সংগঠনটি নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।
প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করিয়া বিগত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এ সম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।
১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করে শতশত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের হত্যা করেছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে। যেহেতু সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত।
সেহেতু সরকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’-এর ধারা ১৮ এর উপধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং ওই আইনের তপশিল-২ এ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামীয় ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করল।
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্বাক্ষরিত এ প্রজ্ঞাপন অবিলম্বে কার্যকর হইবে বলেও জানানো হয়।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অ্যাসেম্বলি হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সংগঠনটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং এই সংগঠনের প্রথম অফিস ছিল ১৫০ মোগলটুলীতে। এই ১৫০ মোগলটুলীই ছিল মুসলিম লীগেরও অফিস। অবিভক্ত পাকিস্তানের সর্বপ্রথম ছাত্র সংগঠন এটি। সাম্প্রদায়িক অভিযোগ থেকে রক্ষা পেতে একই সঙ্গে ছাত্রলীগের নামেও পরিবর্তন আসে, ছাত্রলীগের নাম হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’।
সংগঠনটির প্রথম আহ্বায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। সাংগঠনিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু করলে সভাপতি মনোনীত হন দবিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক হন খালেক নেওয়াজ খান। স্বাধীনতার পর দলের নামেও পরিবর্তন আসে। ছাত্র লীগের নাম হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১১ দফা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্বাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগ মুজিব বাহিনী গঠন করে এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৭২ সাল থাকে ১৯৭৫ কালপূর্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের সংগ্রামে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল। সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্র-ঐক্যের ১০ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
পরে বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে দলাদলি, অন্তর্কোন্দল, প্রতিপক্ষের ওপর হামলাসহ নানা কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে ছাত্রলীগ। সংগঠনটির বিরুদ্ধে নির্যাতন, চাঁদাবাজি, সহিংসতা, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ছাত্রলীগের হামলায় কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত এবং ১ হাজার ৫০০ জন গুরুতর আহত হয়। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১২৯ জনে। শুধু ২০১৮ সালেই ৩১ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ঢাকা হামলার পর জঙ্গি তল্লাশিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাত-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে এক ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০২১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সঙ্গেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ইডেন মহিলা কলেজ শাখার ছাত্রীদের ব্ল্যাকমেইল করে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি চক্র চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
সর্বশেষ ২০২৪ সালে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্মকাণ্ডের কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্র সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করল।