বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) পরীক্ষাসহ গত ১২ বছরে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগের মামলায় পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। স্বীকারোক্তিতে তার দেওয়া প্রশ্নে কারা কারা ক্যাডার হয়েছেন তাদের নাম বলে দিয়েছেন বলে সূত্রে জানা গেছে।
ওই সূত্র জানায়, এখন আবেদ আলীর দেওয়া নামের তালিকা প্রণয়নের কাজ থেকে শুরু করেছে একটি সংস্থা।
মুখভর্তি দাঁড়ি, মাথায় টুপি। এলাকায় ধর্মভীরু মানুষ হিসেবে পরিচিত সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলীকে নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে।
লেবাসধারী আবেদ আলীর বাড়ি মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বোতলা গ্রাম। রেলস্টেশনের কুলি থেকে রিকশাচালক, এর পর পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালক হয়ে কোটিপতি বনে যাওয়া আবেদ আলী নিজ এলাকায় দানবীর হিসেবে পরিচিত।
জানা যায়, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক সদস্য দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানের গাড়িচালক ছিলেন আবেদ আলী। তার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ থাকতো। তারা কাস্টমার যোগাড় করে দেওয়ার দায়িত্বে ছিল।
অধ্যাপক মাহফুজুরের বিরুদ্ধে ২৭তম বিসিএস এর মৌখিক পরীক্ষায় ঘুষ গ্রহণসহ পরীক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রকাশিত প্রথম ৫০ জন সন্দেহভাজন ‘দুর্নীতিবাজের’ তালিকায় অধ্যাপক মাহফুজের নাম ছিল।
আলোচনা আছে, তার হাত ধরেই প্রশ্নফাঁস এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হন আবেদ আলী। গত ১২ বছরে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাসহ সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার অন্তত ৩০টি প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন তিনি। তার দেওয়া প্রশ্নে যারা ক্যাডার হয়েছেন, তাদের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কাউকে কাউকে রাখা হয়েছে নজরদারিতেও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিমেল চাকমা বলেন, এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আবেদ চক্রের প্রশ্নে বিসিএসের কয়েকটি ব্যাচের অনেকেই ক্যাডার হয়েছেন। এখন গ্রেফতারকৃতদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী জানিয়েছেন, তিনি শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক। ঢাকায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি রয়েছে। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ডুপ্লেক্স ভবন। একজন গাড়িচালক যদি শত শত কোটি টাকার মালিক হন, তাহলে তিনি পিএসসির যাদের হয়ে কাজ করেছেন তারা কত হাজার কোটি টাকার মালিক।
সূত্র আরও জানায়, গত তিন মাসে আবেদ চক্রের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অন্তত ২৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সহায়তায় সিআইডি ১৭ আসামির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নথি জব্দ করেছে।
এসব নথি পর্যালোচনা করে একাধিক অর্থপাচার মামলা হতে পারে বলে সূত্র জানায়।
সিআইডির সাইবার তদন্ত ও অপারেশনের বিশেষ সুপার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে পিএসসি কর্মকর্তাসহ ১৭ জন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। আরও কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গেও এই সিন্ডিকেট জড়িত ছিল বলে জানান তিনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে ডাসার উপজেলার একজনকে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরে চাকরি দিয়ে প্রথমে আবেদ আলীর উত্থান শুরু। এর পর তিনি এলাকার অনেকের ‘চাকরির ব্যবস্থা’ করে দিয়েছেন।
গাড়িচালক হলেও এলাকায় নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিতে আবেদ আলী। পরিবার ও প্রতিবেশীরা ছাড়া সবাই জানতেন তিনি ঢাকার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
কালকিনি ভেঙে ডাসারকে নতুন উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করা হলে উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য প্রচারণা শুরু করেন আবেদ আলী। এলাকায় দানবীর হিসেবে ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টায় ছিলেন তিনি। এলাকায় তিনি ও তার ছেলে সিয়াম কোটি টাকা দামের দুটি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করতেন। স্থানীয় মসজিদ, মন্দির, এতিমখানা ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে টাকা দানও করতেন।