শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন দেশের অন্যতম সেরা করদাতা কাউছ মিয়া। আজ সকালে তাঁর জীবনাবসান হয়েছে। ব্যবসায়ী হিসেবে সেলিব্রিটি নন তিনি; কিন্তু ১৫ বছর ধরে বছরের একটি সময় তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসতেন। সেটা হলো সেরা করদাতা পুরস্কার দেওয়ার সময়।
দেখা যাচ্ছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যখন সেরা করদাতা পুরস্কার দেয়, তখন সব সেলিব্রিটি ও বড় ব্যবসায়ীকে পেছনে ফেলে তিনিই সেরা করদাতা হন। কেমন ছিলেন এই কাউছ মিয়া? কীভাবে তাঁর উত্থান হয়েছিল?
মায়ের দেওয়া আড়াই হাজার টাকার পুঁজিতে ১৯৫০ সালে ব্যবসা শুরু করেন কাউছ মিয়া। মৃত্যুর আগপর্যন্ত সফলভাবে ব্যবসা করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন তিনি। নিজেও দু-একবার বলেছেন, তাঁর কত সম্পদ আছে তা অনেকের কল্পনারও বাইরে।
বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাঁদপুরের পুরান বাজারে মুদিদোকান দেন। এরপর ধীরে ধীরে ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট হন কাউছ মিয়া। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি চাঁদপুরেই ব্যবসা করতেন।
১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন কাউছ মিয়া; শুরু করেন তামাকের ব্যবসা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ৪০-৪৫ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। যদিও তাঁর মূল ব্যবসা ছিল তামাক বেচাকেনা। হাকিমপুরী জর্দার মালিক হিসেবে সারা দেশে পরিচিত তিনি; হাকিমপুরী জর্দার কৌটায় তাঁর ছবি আছে।
একবার আমদানি ব্যবসার লাইসেন্স নিয়েছিলেন কাউছ মিয়া। এ ব্যবসায় কারসাজি না করলে টিকে থাকা মুশকিল—এই চিন্তা থেকে আমদানির ব্যবসা ছাড়েন। নদীপথে পণ্য পরিবহনের জন্য ১৮টি কার্গো জাহাজ ছিল কাউছ মিয়ার। এই ব্যবসা তাঁর ছেলেরা দেখাশোনা করেন।
কাউছ মিয়া ১৯৫৮ সালে কর দেওয়া শুরু করেন। ২০১৯ সালে এনবিআরের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আগে টাকাপয়সা এখানে-সেখানে রাখতাম। এতে নানা ঝামেলা ও ঝুঁকি ছিল। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দিয়ে “ফ্রি” হয়ে গেলাম। এরপর সব টাকাপয়সা ব্যাংকে রাখতে শুরু করলাম। হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার করে রাখলাম।’ ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক নম্বর করদাতা হয়েছিলেন কাউছ মিয়া।
২০১৯ সালের সেরা করদাতা পুরস্কার দেওয়ার সময় কাউছ মিয়াকে নিয়ে এক গল্প বলেছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তৎকালীন চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। তিনি বলেছিলেন, কাউছ মিয়া প্রতিবছর আয়কর বিবরণী জমা দেন। পুরস্কার দেওয়ার সময় এলে সংশ্লিষ্ট মাঠপর্যায়ের কর কর্মকর্তারা কাউছ মিয়াকে বলেন, ‘এবার মনে হয় আপনি সর্বোচ্চ করদাতা হতে পারবেন না।’ তখন কাউছ মিয়া বলেন, কত টাকা দিলে সর্বোচ্চ করদাতা হতে পারব? এর দু-এক দিন পরেই তিনি ৫ কোটি টাকার চেক পাঠিয়ে দেন। অর্থাৎ সেরা করদাতা হওয়ার প্রতিজ্ঞা ছিল তাঁর।
কাউছ মিয়ার ২২ পৃষ্ঠার এক টাইপ করা জীবনীতে এসেছিল। শীর্ষ করদাতা হিসেবে কাউছ মিয়া কত কর দেন, সেখানে এর ধারণা পাওয়া যায়। জর্দার ব্যবসা থেকে তখন (২০১৭ সাল) মাসে ৪০-৫০ লাখ টাকা কর দিতে হতো। সব মিলিয়ে কাউছ মিয়া প্রতিবছর প্রায় ৪৫ কোটি টাকা কর দিতেন বলে এনবিআর সূত্রে জানা যায়।
নিজের বিষয়ে অনেকটাই অকপট ছিলেন কাউছ মিয়া। কালোটাকা সাদা করেছেন, সে কথাও ওই জীবনীতে পাওয়া যায়: ‘সরকার যখন অঘোষিত টাকা বৈধ করার জন্য ১০ শতাংশ কর ঘোষণা করেছে, তখন কাউছ মিয়া সরকারের ঘোষণায় সাড়া দিয়ে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অঘোষিত টাকা হোয়াইট করে নিয়েছেন। গাড়ি বোঝাই করে ব্যবসায়িক মুনাফার সকল অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়ে সাদা করে নিয়েছেন। তখন তিনি মুনাফার অর্থ দিয়ে ঢাকা শহরে কয়েকটি বাড়ি ও জায়গা কিনেছেন।’
কাউছ মিয়ার বিশেষত্ব হলো ঢাকার বড় ব্যবসায়ীদের মতো গুলশান-বনানী কিংবা মতিঝিলে বিলাসবহুল কার্যালয় নেই তাঁর। পুরান ঢাকার আগা নওয়াব দেউড়ি রোডের হাকিমপুরী জর্দার কারখানার একটি কক্ষই তাঁর ‘চেম্বার’। মৌলভীবাজার থেকে সরু এই গলিপথ ধরে কিছুটা পথ হাঁটলেই তাঁর কারখানা। সেখানেই বসতেন তিনি। কিন্তু গুলশান-বনানী, মতিঝিলের ডাকসাইটে ব্যবসায়ীদের পেছনে ফেলে পুরান ঢাকার ঘুপচি গলির এই ব্যবসায়ীই প্রতিবছর সর্বোচ্চ করদাতা হতেন।