ভারত সরকার ১০০ মেট্রিক টন সোনা ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। এ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা, কোথা থেকে এল এই সোনা। ভারত সরকারই বা কেন এই সোনা বিদেশে রেখেছিল। এখানেই শেষ নয়, আগামী মাসে আরও সোনা ভারতে ফিরিয়ে আনা হবে বলেও জানা যায়।
কেন এই সোনা ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কিছুটা পেছনে যেতে হবে। এর সঙ্গে ১৯৯০-এর দশকে ভারতে যে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তার যোগ আছে। সোনা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বর্তমান ভূরাজনীতির প্রভাব আছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে বলে জানাচ্ছে দ্য হিন্দু।
ভারতের মূল আমদানি পণ্য হলো জ্বালানি তেল। ভারত একসময় ইরাকের কাছ থেকেই মূলত তেল আমদানি করত। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে ইরাক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারি—এসব কারণে তেলের দাম অনেকটা বেড়ে যায়। তেলের সংকট সৃষ্টি হয় ভারতে। বাড়তি দামে তেল কিনতে প্রয়োজন ছিল পর্যাপ্ত ডলারের। কিন্তু ভারতের অর্থনীতির দরজা তখন বন্ধ। কীভাবে ডলার পাওয়া যাবে, তার পথ খুঁজতে থাকে তৎকালীন ভারত সরকার।
সেই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক থেকে ডলার নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না ভারতের। কিন্তু এই দুই সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেওয়া মানে একগাদা শর্ত মেনে নেওয়া। ভারত সে সময় বিকল্প পথ খুঁজতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে বিদেশি ব্যাংকে সোনা বন্ধক রেখে ডলার নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি এড়িয়ে অন্য কোনো বিদেশি ব্যাংকে সোনা জমা রাখা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এবং ব্যাংক অব জাপানের কাছে সোনা জমা রাখে ভারত; তার বিনিময়ে নেয় ডলার। এই পুরো বিষয়টি ভারত সরকার গোপন রাখার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তা পারেনি; কয়েকটি সংবাদপত্র সেই খবর ফাঁস করে দেয়। সেই সোনাই এবার ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কাছে এখন ৮২২ মেট্রিক টন সোনা আছে। বিগত পাঁচ বছরে ভারত ২০৩ দশমিক ৯ মেট্রিক টন সোনা কিনেছে; সেই সোনার কিছু অংশ আরবিআইয়ের কাছে মজুত আছে। কিছু বিদেশি ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছ।
জানা যায়, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের মাটির নিচে থাকা নয়টি বড় বড় ভল্টে এসব সোনার বার থাক থাক করে সাজানো থাকে। শুধু ভারতের নয়, বিভিন্ন দেশের সোনা ওই ভল্টে জমা রাখা হয়। খুবই সুরক্ষিত জায়গা এই ভল্ট; কেউ চাইলেই সেখানে যেতে পারেন না। একমাত্র ইংল্যান্ডের রাজা বা রানিই ওই ভল্টে যেতে পারেন এবং জমা সোনা দেখতে পারেন।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতে এক ভীতি তৈরি হয়েছিল। তখন নীতি নির্ধারকেরা একধরনের উপনিবেশবিরোধী ছিলেন। জনগণের মধ্যেও তখন ভয়, বিদেশি কোম্পানি ভারতের বাজারে ঢুকলে আবারও না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জেঁকে বসে। সে জন্য ভারতের বাজার সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। এসব কারণে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল খুব কম। ১৯৯০-এর দশকের সেই সংকটের পর ভারত অবশ্য আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। পরে তাদের শর্ত মেনে ভারত অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
কথা হচ্ছে, ভারত কেন সোনা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিল। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ অনেক দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বিদেশি ব্যাংকে রাশিয়ার জমা রাখা সোনা জব্দ করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অনেক দেশ বিকল্প চিন্তা করছে; ভারতও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।