রাজধানীর অদূরে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর ফল্টে যদি দিনের বেলায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে রাজধানী ঢাকায় সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ আর সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ ভবন ধসে পড়বে।
শনিবার (১ জুন) রাজধানীর একটি হোটেলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আয়োজিত ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলাবিষয়ক এক সেমিনারে এ তথ্য জানানো হয়।
সেমিনারে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আব্দুল লতিফ হেলালী বলেন, ঢাকায় কাঁচা-পাকা মিলিয়ে ২১ লাখ ৪৬ হাজার ৬২৬টি ভবন আছে। এগুলোর মধ্যে ৫ লাখ ১৩ হাজার ৫০৭টি পাকা বা কংক্রিটের ভবন। আধা পাকা ভবন আছে ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৬২০টি। টাঙ্গাইলের মধুপুরে দিনের বেলা ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীর ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ (৪০.২৮ শতাংশ) হাজার ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় এই ভূমিকম্প হলে মারা যাবে ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ, আহত হবে ২ লাখ ২৯ হাজার। ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে সরকারকে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা।
তিনি বলেন, সিলেটের ডাউকি চ্যুতি রেখায় ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫টি (১.৯১ শতাংশ) ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় ভূমিকম্পটি হলে ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। আহত হবে ২৮ হাজার মানুষ। এই মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
হেলালী বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা শহরে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, পুলিশ স্টেশনের ভবনগুলোর ওপর জরিপ চালানো হয়। এতে ৩ হাজার ২৫২টি ভবনের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। এগুলোর মধ্যে ১৮৭টি ভবন পাওয়া যায়, যেগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ করা সম্ভব। আর ৪২টি ভবন এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে সেগুলোকে অপসারণ করার কথা বলা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ঢাকার জন্য ভূমিকম্প সহনশীল টেকসই উন্নয়ন অনিবার্য এবং পরিকল্পিতভাবে ভবন কোড মেনে উন্নয়ন করতে হবে। অবকাঠামোগত কাজে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আরও সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নেওয়া প্রয়োজন। যা ভবিষ্যৎ সমাজ ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই অবকাঠামোর ব্যাপারে সরকার গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
তিনি বলেন, নিরাপদ অবকাঠামো ঝুঁকি হ্রাস করে, সরকার সেদিকে নজর রাখছে। রাজউকের সাথে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে শহরে ভূমিকম্প সহনশীলতার ব্যাপারেও কাজ চলবে। আমাদের লক্ষ্য উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজে বের করা। বর্তমানের পরিকল্পনাই ভবিষ্যতের ঢাকাকে গড়ে তুলবে।
সালমান এফ রহমান বলেন, ১২৫ বছর ধরে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সহসাই একটি বড় ভূমিকম্প হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করছে সরকার। যত দ্রুত সম্ভব এ কাজটি করতে হবে। সরকার ভূমিকম্প সহনীয় ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও এলাকা চিহ্নিত করছে। ঢাকা শহরকে ভূমিকম্প সহনশীল করে তুলতেও সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, দ্রুত নগরায়ণ, নির্মাণ নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং নৈতিকতার অভাবের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের সব জেলা শহর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে শহরের উন্মুক্ত স্থানসমূহ বেদখল হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার দ্রুত বৃদ্ধি এবং অভিবাসনের ফলে ভূমিকম্প এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপদের ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে। ভবনের তদারকির সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম চাপিয়ে না দিয়ে জনগণের মাঝে ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সবাই একত্রে কাজ করেই রাজধানীকে ভূমিকম্প সহনশীল করতে হবে।
রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নবিরুল ইসলাম। এ ছাড়া গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. শামীম আখতার, স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি মীর মঞ্জুরুর রহমান, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বাংলাদেশ পুলিশ, বিশ্বব্যাংক, ইউএসএআইডি, জাইকা, এডিবি, আইইবি, বিআইপি, আইডিইবির প্রতিনিধিসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন।