২০২৪ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় গণিতে অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করেছে। গতকাল প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর গণিতে নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড মিলে ফেলের হার ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ। সংখ্যার হিসাবে প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০২ শিক্ষার্থী বিষয়টিতে ফেল করেছে।
গতকাল সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৪ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। পরে দুপুর সাড়ে ১২টায় সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
গণিত ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বাংলায় ১ দশমিক ৮৫, ইংরেজিতে ৪ দশমিক ৭৭, পদার্থবিজ্ঞানে ২ দশমিক ৩৫, রসায়নে ১ দশমিক ৯০, আইসিটিতে ২ দশমিক শূন্য ৪, হিসাববিজ্ঞানে ২ দশমিক ৮৫ ও পৌরনীতিতে ২ দশমিক ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে।
বোর্ডভিত্তিক ফলাফলে গণিতে এ বছর সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে মাদ্রাসা বোর্ড। বোর্ডটিতে ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই গণিতে ফেল করেছে। এর পরে রয়েছে ঢাকা বোর্ড, গণিতে ফেলের হার ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ। অন্যদিকে এবার গণিতে সবচেয়ে ভালো ফল করেছে যশোর বোর্ড, পাসের হার ৯৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এছাড়া রাজশাহী বোর্ডে ৬ দশমিক ২৬, কুমিল্লা বোর্ডে ১২ দশমিক শূন্য ৪, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৭ দশমিক ৬৩, বরিশাল বোর্ডে ৭ দশমিক শূন্য ৪, সিলেট বোর্ডে ৬ দশমিক ৩৯, দিনাজপুর বোর্ডে ১১ দশমিক ৯০ ও ময়মনসিংহ বোর্ডে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে ফেল করেছে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা জানান, গণিতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব এবং প্রাথমিক পর্যায় থেকে গণিতের দুর্বলতাই শিক্ষার্থীদের খারাপ ফলাফলের পেছনে মুখ্য কারণ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের দেশে গণিতে দক্ষ শিক্ষকের খুবই অভাব। বিশেষত মাধ্যমিক পর্যায়ে যারা গণিত পড়াচ্ছেন, তাদের অনেকে স্নাতক পর্যায়ে গণিত বিষয় পড়েননি। ফলে শিক্ষার্থীদের ওপর এর একটি প্রভাব পড়ছে। এছাড়া এ বছর ঢাকা বোর্ডে প্রশ্নও তুলনামূলক কঠিন হয়েছিল।’
একই তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) শিক্ষা পরিসংখ্যানেও। শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২১ অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরে গণিত পাঠদান করা শিক্ষকদের প্রায় ৮১ শতাংশই স্নাতকে গণিত পড়েননি। প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গণিতের ৬৭ হাজার ৯৫৫ শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন ১৩ হাজার ১২৭ জন। এছাড়া ৭ হাজার ২৮৫ শিক্ষকের গণিতে স্নাতকোত্তর আছে। কিন্তু স্নাতক করেছেন কিনা তা জানা যায়নি। এ হিসাবে গণিতে স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আছেন শুধু ১৯ শতাংশ শিক্ষক।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুল মজিদ বলেন, ‘ফল কেন খারাপ হলো এ বিষয়ে আমরা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করব। কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’
একই কথা বলছেন দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক স ম আব্দুস সামাদ আজাদ। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে যে তিনটি বোর্ড সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে তার মধ্যে একটি দিনাজপুর। বোর্ডটির চেয়ারম্যান বলেন, ‘গণিত তুলনামূলক কঠিন বিষয় এবং অনেক শিক্ষার্থীরই গণিতে প্রাথমিক থেকে দুর্বলতা থাকে, যা পরে কাটিয়ে উঠতে পারে না। আর এ বছর পরীক্ষার পর থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন কঠিনের বিষয়ে বলছিলেন। আমরা বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রায়ই স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করি। গণিতে ফল খারাপের বিষয়টি নিয়েও আমরা আলোচনা করব এবং দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানে উদ্যোগ নেব।’
ফল ভালো করতে দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলে মনে করেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আহসান হাবীব। তিনি বলেন, ‘এর আগে এইচএসসিতে যশোর বোর্ডের ফল খারাপ হয়েছিল। এর পর থেকে আমরা স্কুল-কলেজগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বিভিন্ন সভা-সেমিনার করেছি। কেন ফল খারাপ হলো সে বিষয়গুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। কিছু বিষয় চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেয়া হয়েছে। ফলস্বরূপ আমরা এবার এসএসসিতে বেশ ভালো ফল করেছি।’
গণিতে ভালো ফল করতে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের গণিতচর্চা আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ড. সমীর কুমার ভৌমিক বলেন, ‘যেকোনো বিষয়েই দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প নেই। গণিতও এর ব্যতিক্রম নয়। এছাড়া গণিতচর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা যত বেশি গণিত চর্চা করবে, তত বেশি দক্ষ হয়ে উঠবে। তাই গণিতে দুর্বলতা দূর করতে অবশ্যই গণিতচর্চায় জোর দিতে হবে।’