গত কয়েক বছরে ঢাকা শহরে বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। অভিজাত বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি প্রতিটি এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। ভোজন রসিকদের রসনাবিলাসের পাশাপাশি পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটানোর অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে রেস্টুরেন্টগুলো। তবে বিভিন্ন সময়ে অনেক রেস্টুরেন্টের খাবারের মান ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কোটেজ নামে একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে। ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতের ওই ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ওই ভবনে থাকা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন।
এরপর ঢাকা শহরে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায় একাধিক সংস্থা। এ সময় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকা এবং বৈধ অনুমোদন থাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট। আপাতত, অভিযান কিছুটা গতি হারালেও জনমনে পুরোপুরি স্বস্তি আসেনি। অনেকেই রেস্টুরেন্টের নিরাপত্তা ও বৈধতার বিষয়টি নিয়ে শঙ্কায় ভুগছেন।
আর এর মধ্যেই জানা গেল, ঢাকা শহরে গড়ে ওঠা হাজার হাজার রেস্টুরেন্টের মধ্যে মাত্র ১২৮টির বৈধ অনুমোদন রয়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্যের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বৈধ রেস্টুরেন্ট রয়েছে ১২৮টি। পাশাপাশি ঢাকা জেলার উপজেলাগুলোর মধ্যে শুধু সাভারে ৬টি রেস্টুরেন্টের লাইসেন্স রয়েছে। ধামরাই, কেরানীগঞ্জ, দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার কোনো রেস্টুরেন্টের লাইসেন্স। সব মিলিয়ে পুরো জেলায় মাত্র ১৩৪ টি রেস্টুরেন্টের বৈধ লাইসেন্স রয়েছে।
আর বৈধ অনুমোদন না থাকার পেছনে কারণ হিসেবে নিবন্ধন ও লাইসেন্সপ্রক্রিয়া জটিল বলে দাবি রেস্টুরেন্ট মালিকদের।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করতে চাইলে একজন বিনিয়োগকারীকে সরকারের সাতটি সংস্থার অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হয়। রেস্টুরেন্টের জন্য প্রথমে নিবন্ধন ও পরে লাইসেন্স নিতে হয় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে। বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রসহ নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে প্রথমে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয় থেকে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করার জন্য নিবন্ধন (অনুমতি) নিতে হয়। এই নিবন্ধন পাওয়ার পর ডিসির কার্যালয় থেকেই ব্যবসার লাইসেন্স (সনদ) নিতে হয়। আইন অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাইয়ের পর এক বছরের মধ্যেই ডিসির কার্যালয় লাইসেন্স দেয় নিবন্ধন পাওয়া রেস্টুরেন্টকে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পাশাপাশি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হয় একজন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীকে। এর বাইরে দই ও বোরহানির মতো বোতল বা প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্য কোনো রেস্টুরেন্ট বিক্রি করলে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নিতে হয়।
আর এই একাধিক সংস্থার কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়ার প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ দাবি করে দায় এড়ানোর চেষ্টা রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “নিয়ম হচ্ছে নিবন্ধন পাওয়ার পর রেস্টুরেন্ট নির্মাণের কাজ শুরু করবেন একজন বিনিয়োগকারী। একইসঙ্গে তিনি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য সরকারি অন্যান্য সংস্থা থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও ছাড়পত্র নেবেন। লাইসেন্স পাওয়ার আগে কোনো রেস্টুরেন্ট খাবার বিক্রি করতে পারবে না। যেসব রেস্টুরেন্টের লাইসেন্স আছে, শুধু তারাই বৈধ। আবার নিবন্ধন পাওয়ার এক বছরের মধ্যে লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রসহ আবেদন না করলে নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে।”
তবে ২০২২ সাল থেকে ঢাকা শহরে লাইসেন্স নিয়ে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনার প্রবণতা কিছুটা বাড়তে দেখা যায় বলে প্রথম আলোকে জানান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা। তিনি জানান, ২০২২ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নিয়েছে। এরপর ২০২৩ সালে ৩০টি এবং ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত ১৫টি প্রতিষ্ঠান রেস্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনার জন্য লাইসেন্স নিয়েছে।
লাইসেন্স পেতে এখন ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদন আছে ৬৪টি; যারা ইতিমধ্যে ব্যবসা পরিচালনার জন্য নিবন্ধন পেয়েছে।
বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন অনুযায়ী, ৩০ জন বা এর চেয়ে বেশি মানুষ যেখানে বসে মানসম্মত খাবার টাকার বিনিময়ে খেতে পারবেন, সেটিকে রেস্টুরেন্ট বলা হয়।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি বলছে, ঢাকায় এখন ২৭ হাজারের মতো রেস্টুরেন্ট। তবে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, রাজধানীতে রেস্টুরেন্টে সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।
ব্যবসায়ীদের দাবি, লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজ হলে অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা করতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তারা বলছেন, লাইসেন্স পেতে কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হয়, যেগুলো জোগাড় করতে করতেই মাসের পর মাস চলে যায়। অনেকে এই ব্যবসা করার ধৈর্য ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
জানা গেছে, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করতে চাইলে প্রথমে নিবন্ধন করতে হয়। এজন্য বেশ কিছু নথি ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দিতে হয়। নিজের জমিতে রেস্টুরেন্ট করলে একরকম নথি এবং ভাড়া করা ভবনে করলে আরেক রকম নথি দিতে হয়।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাসান বলেন, “লাইসেন্স নিতে গেলে ভবনের মূল দলিলের ফটোকপি, ভবনের নকশার অনুমোদন জমা দিতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভবনমালিকেরা এসব নথি রেস্টুরেন্টের মালিকদের দিতে চান না। আবার সরকারের সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণে রেস্টুরেন্ট মালিকদের ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। ভোগান্তি এড়াতে অনেকেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে লাইসেন্স করেননি।”
তবে লাইসেন্স না করলেও অগ্নি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস দুর্ঘটনার নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাসংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের সনদপত্রের বেশির ভাগ রেস্টুরেন্টমালিক নিয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।
নগর-পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, ঢাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের পাশাপাশি হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাই রেস্টুরেন্টগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনা দরকার। অন্যদিকে, বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির দাবি; দেশের সব রেস্টুরেন্টসেবাকে একটি সংস্থার অধীন এনে লাইসেন্স প্রদান করা।