এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ছড়াছড়ি হলেও ৩২টি আসনে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই। আসনগুলোর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট কয়েক জন প্রার্থীর আসন রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকায় এবং ডামি প্রর্থী না দেওয়ার কারণে এসব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের কর্মকর্তারা। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা দলের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেছে ইসি। সংস্থাটির দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী নির্বাচনে আসা নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ২৯টি। তবে ইসির এ তালিকায় নির্বাচন বর্জনকারী একটি দলও রয়েছে। যা নিয়ে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলটির মহাসচিব নিজেই। ফলে ইসির এ তালিকা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
এদিকে নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রেখেছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। গত কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায় গতকালও কয়েক জন প্রার্থীকে শোকজ করা হয়েছে। নির্বাচনি আচরণবিধি নিয়ে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের টকশো এবং পত্রপত্রিকায় কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি মনগড়া বক্তব্য দিচ্ছেন বলে মনে করছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
হঠাৎ করে মাঠ প্রশাসনে ব্যাপক রদবদলের বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, মাঠের তথ্যের ভিত্তিতেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) রদবদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইসির তথ্যানুযায়ী, ৩২টি আসনে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি। এই আসনের মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য আমির হোসেন আমু, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, শেখ হেলাল উদ্দিন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ক ম রুহুল হক, সাবের হোসেন চৌধুরী, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের আসন।
ইসির হিসেব অনুসারে ৭৪৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন; যা গতবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তুলনায় প্রায় ২৬০ জন বেশি। এবার যে ৩২টি আসনে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই সেগুলো হচ্ছে—ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪. কুমিল্লা-৯ ও কুমিল্লা-১০, নোয়াখালী-৫, চট্টগ্রাম-৭, ৯ ও ১৩, কক্সবাজার-২, পঞ্চগড়-২, মাগুরা-১, বাগেরহাট-১, পটুয়াখালী-১, শরীয়তপুর-৩, সিলেট-৪ ও ৬, কিশোরগঞ্জ-৪, মানিকগঞ্জ-৩, ঢাকা-১, ঢাকা-৯, ঢাকা ১৫, নারায়ণগঞ্জ-৫, মাদারীপুর-১ ও ২, টাঙ্গাইল-১, টাঙ্গাইল ৮, ময়মনসিংহ-৯, ভোলা-২, বরিশাল-১, ঝালকাঠি-২, বগুড়া-৫ সিরাজগঞ্জ-২ এবং পাবনা-৫ আসন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যে বিভ্রান্তি: নির্বাচন কমিশন (ইসি) এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০৩ জন প্রার্থী দিয়েছে জানালেও হিসেবে গরমিল পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন থেকে গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রার্থী তালিকায় চট্টগ্রাম-আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নাম দুইবার লেখা হয়েছে। ঝালকাঠি-১ আসনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর-উত্তম আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও নির্বাচন কমিশন তাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করেছে।
আরো আট প্রার্থীকে শোকজ: নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে আরও ছয় প্রার্থীকে শোকজ করেছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। এর মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম-১৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন, সিলেট-২ আসনে জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী মো. ইয়াহইয়া চৌধুরী, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. মোহাম্মদ সাদিক, ঢাকা-২০ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাদ্দেছ হোসেন, গাইবান্ধা-১ আসনে জাতীয় পার্টি-জাপার প্রার্থী শামীম হায়দার পাটোয়ারী, গাইবান্ধা-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আফরুজা বারী, নারায়ণগঞ্জ-৩ জাপার প্রার্থী লিয়াকত হোসেন খোকা, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমান। বৃহস্পতি ও শুক্রবার আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে সরকারের চারজন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি-জাপা ও স্বতন্ত্রসহ অন্তত ৩৬ জন প্রার্থীকে শোকজ করে নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি। তাদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে শোকজের জবাবও দিয়েছেন।
টকশোতে কিছু ব্যক্তি মনগড়া বক্তব্য দিচ্ছেন—ইসি: নির্বাচনি আচরণবিধি নিয়ে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের টকশো এবং পত্রপত্রিকায় কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি মনগড়া বক্তব্য দিচ্ছেন বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির ভাষ্যমতে, ‘গণমাধ্যমে প্রচারিত বিশিষ্টজনদের এমন মনগড়া বক্তব্য জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারে।
নির্বাচন বর্জনকারী দল ইসির তালিকায়: নির্বাচন কমিশনের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য ৪৪টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় পার্টি-জেপি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টিসহ ২৯টি রাজনৈতিক দল আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী, এসব দল নিজেদের প্রার্থী ও প্রতীক চূড়ান্তকরণের জন্য স্বাক্ষর নির্দিষ্ট করে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে কমিশনকে অবহিত করে। অন্যদিকে সরকারবিরোধী বিএনপিসহ বাকি ১৫টি দল নির্বাচনের বাইরে রয়ে গেছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন বর্জনকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ মুসলিম লীগকেও স্থান দিয়েছে ইসি, যা নিয়ে দলের মহাসচিব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। দলটি নির্বাচন বর্জনে থাকলেও দিনাজপুর-৩ আসনে আব্দুস সালাম ও লালমনিরহাট-২ আসনে মো. বাদশা মিয়াকে প্রার্থী দিয়েছে বলে তথ্য দেয় ইসি।
মাঠের তথ্যানুযায়ী ইউএনও-ওসিদের বদলির সিদ্ধান্ত—ইসি :নির্বাচন কমিশনাররা বিভিন্ন জেলায় সংসদ নির্বাচনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে যে তথ্য পেয়েছেন, তার ভিত্তিতেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) রদবদলের সিদ্ধান্ত দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেছেন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। ওসি ও ইউএনওদের রদবদল সরকার চেয়েছে, নাকি আপনারা চেয়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি নির্বাচন কমিশন চেয়েছে। আমাদের কমিশনাররা গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চল পর্যায়ে সফর করেছেন। তাদের যে ফাইন্ডিংস, তার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন বসে গত ৩০ নভেম্বর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) বদলির কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না, জানতে চাইলে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আমার জানা নেই।’
স্বতন্ত্র প্রার্থীর নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা ইতিমধ্যে মাঠ পর্যায়ে মেসেজ দিয়েছি।’