আমরা মাঝে মাঝেই প্রয়োজনে বা আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ নেয়া ও বেড়াতে মেহমান হয়ে তাদের (আত্মীয়-স্বজন) বাড়িতে যাই। মেহমান হয়ে অন্যের বাড়ি যাওয়ার আগে নিজের কিছু করণীয় থাকে। ওই বাড়িতে যাওয়ার আগে তাদের জানানো বা পূর্বানুমতি নেয়া, আপনার হঠাৎ গমনে যেন তারা বিব্রত না হয় এবং মেহমান যেন কষ্টের কারণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা।
মেহমান হয়ে কোনো বাড়িতে গেলে প্রথমে সালামের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে হয়। কারও বাড়িতে মেহমান হয়ে গেলে সঙ্গে অতিরিক্ত মানুষ না নেয়া উত্তম। একই সঙ্গে অনুমতি না নিয়ে ঘর ত্যাগ না করাও উচিত নয়।
وَعَنْ أَبِي شُرَيْحٍ الْكَعْبِيِّ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ جَائِزَتُهُ يَوْمٌ وَلَيْلَةٌ وَالضِّيَافَةُ ثَلَاثَةُ أَيَّامٍ فَمَا بَعْدَ ذَلِكَ فَهُوَ صَدَقَةٌ وَلَا يَحِلُّ لَهُ أَنْ يَثْوِيَ عِنْدَهُ حَتَّى يُحَرِّجَهُ»
আবূ শুরাইহ্ আল-কা’বী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে। অতিথির জন্য উত্তম খানা-পিনার ব্যবস্থা করা চাই এক দিন ও এক রাত। আর মেহমানদারী হলো তিন দিন। এটার পর যা করবে তা হবে সাদাকা। মেহমানের জন্য জায়িয নয় এত সময় মেজবানের গৃহে অবস্থান করা যাতে তার কষ্ট হয়।
সহীহ : বুখারী ৬১৩৫, মুসলিম (৪৮)-১৪, তিরমিযী ১৯৬৮, আবূ দাঊদ ৩৭৪৮, ইবনু মাজাহ ৩৬৭৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫২৮৭, মুওয়াত্ত্বা মালিক ৩৪৩৪, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১২৫৭, সহীহ আদাবুল মুফরাদ ২৯৭।
মেহমানের কিছু করণীয় ও আদব রয়েছে। নিম্নে তার কিছু উল্লেখ করা হল-
১. কারো বাড়িতে প্রবেশের সময় দৃষ্টি অবনত রাখা, যেন ঘরের কোনো নারীর প্রতি দৃষ্টি না পড়ে যায়। -মিন আদাবিল ইসলাম, পৃ. ৩৪
২. (পরিস্থিতি বিবেচনা করা) মেযবান বসতে বলার আগে না বসা। তদ্রূপ নিজের থেকে কোনো জায়গায় বসে না পড়া। বরং মেযবান যেখানে বসতে বলবেন সেখানে বসবে। -মিন আদাবিল ইসলাম, পৃ. ৩৫
৩. যে ঘরে বা যে দিকে নারীরা অবস্থান করে সেদিকে দৃষ্টিপাত না করা।
৪. মেযবানের কাছে এত বেশি সময় অবস্থান না করা, যা তার জন্য কষ্টের কারণ হয়। -মিন আদাবিল ইসলাম, পৃ. ৩৯
৫. মেযবানের কাছে নির্দিষ্ট কোনো খাবারের আবদার না করা। হাঁ, যদি তার সাথে উষ্ণ সম্পর্ক হয় এবং এই আবদারে তিনি খুশি হন তাহলে দোষ নেই।
৬. খাবার পর্ব শেষ হওয়ার পর বেশি কথাবার্তা বা আলাপচারিতায় লিপ্ত না হয়ে যত দ্রুত সম্ভব মেযবানের কাছ থেকে বিদায় নেয়া। -আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী ৩/১৭৭
৭. মেজবানের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করা। এত বেশিদিন অবস্থান না করা, যে কারণে মেজবানের কষ্ট হয় এবং মেহমানকে খাওয়ানোর মতো ভালো কিছু তার কাছে থাকে না ।
হাদীস শরীফে এসেছে, কোনো মুসলিমের জন্য এটা বৈধ নয় যে, সে তার ভাইয়ের কাছে এত বেশিদিন অবস্থান করে যে তাকে গুনাহে লিপ্ত করে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, এটা কীভাবে? নবীজী বললেন, মেহমান এতদিন অবস্থান করল যে তাকে খাওয়ানোর মত কিছু মেজবানের কাছে অবশিষ্ট থাকল না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮
৮. মেহমানের সাথে যদি অনিমন্ত্রিত কেউ যুক্ত হয় তাহলে মেযবানের কাছে তার ব্যাপারে অনুমতি নেয়া।
৯. মেযবানের জন্য দুআ করা। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিভিন্ন দুআ বর্ণিত হয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আব্দুল্লাহ ইবনে বুস্র রা.-এর বাবার আতিথ্য গ্রহণের পর তার জন্য নি¤েœাক্ত দুআ করেছিলেন-
اَللّٰهُمَّ بَارِكْ لَهُمْ فِيْ مَا رَزَقْتَهُمْ، وَاغْفِرْ لَهُمْ وَارْحَمْهُمْ.
হে আল্লাহ! আপনি তাদের রিযিকে বরকত দান করুন, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদের প্রতি রহম করুন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৪২
তেমনি কারো কাছে ইফতার করলে বা আতিথ্য গ্রহণ করলে নিম্নের দুআও পড়বে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সা‘দ ইবনে উবাদার কাছে এলে তিনি তার সামনে খাবার পেশ করলেন। খাবার শেষে নবীজী দুআ করলেন-
أفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصَّائِمُوْنَ، وَأَكَلَ طَعَامَكُمُ الْأَبْرَارُ، وَصَلَّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلاَئِكَةُ.
রোজাদারেরা তোমাদের কাছে ইফতার করুন, নেক লোকেরা তোমার আতিথ্য গ্রহণ করুন এবং ফিরিশতারা তোমাদের জন্য রহমতের দুআ করুন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২১৭৭
অন্য বর্ণনায় দুআটি এভাবে আছে-
أَكَلَ طَعَامَكُمُ الْأَبْرَارُ، وَصَلَّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَأَفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصَّائِمُونَ
-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৪০৬
তেমনিভাবে যে পান করালো বা আহার করালো তার জন্য নিম্নোক্ত শব্দমালায় দুআ করা যেতে পারে-
اَللّهُمَّ أَطْعِمْ مَنْ أطْعَمَنِيْ، وَاسْقِ مَنْ سَقَانِيْ.
হে আল্লাহ! যে আমাকে আহার করাল আপনি তাকে আহার দান করুন এবং যে আমাকে পান করাল তাকে আপনি পান করান। -সহীহ মুসলিম ২/২৮৪, হাদীস ২০৫৫ (ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপটে)
এগুলোর সাথে সাথে বা এ সকল আরবী দুআ জানা না থাকলে নিজ ভাষায়ও মেজবানের জন্য দুআ করা যায়।
১০. মেহমানদারিতে কোনো অসঙ্গতি বা ত্রুটি দেখা দিলে কোনো মন্তব্য না করা এবং মনক্ষুন্ন না হওয়া; বরং হাসিমুখে বিদায় নেওয়া।