স্ত্রী হত্যা মামলায় স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। বিচারিক আদালতে সাজা হয় মৃত্যুদণ্ড। জায়গা হয় কনডেম সেলে। কেটে যায় ছয় বছর। আপিলের রায়ে খালাস পাবেন, আবার বাইরের আলো দেখবেন, এমন স্বপ্ন হয়তো সে সময়ে দেখেননি আব্দুস সালাম। তবে হয়েছে তাই। হাইকোর্টের রায়ে তিনি পেয়েছেন খালাস। কনডেম সেল থেকে একেবারে মুক্ত জীবন।
হাইকোর্টের রায়ে আসামিপক্ষের বক্তব্য বা সালামের স্বীকারোক্তিকে বেশি গ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তিনি স্ত্রীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার দাবি প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
আদালত ও মামলার নথিসূত্র থেকে জানা যায়, আব্দুস সালামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। পাশের জেলা নাটোরের বনপাড়ায় তিনি প্লাস্টিকের ব্যবসা করতেন। ১৯৯৮ সালে বিয়ে করেন সাবিনা খাতুনকে। বনপাড়া থেকে মাঝে মাঝে বাড়ি যেতেন। তাঁদের দুই সন্তান। ২০০৮ সালের ২৬ জুলাই রাতে তাঁর সঙ্গে কলহের একপর্যায়ে স্ত্রী নিহত হন। পরদিন সালামসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা হয়। গ্রেপ্তারের পর তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ওই রাতে তিনি ভাত চাইলে স্ত্রী সাবিনা রান্না করে খেতে বলেন। তিনি ঘাড়ে ধরে স্ত্রীকে চৌকি থেকে নামান এবং ভাত রান্না করতে বলেন। তিনি চৌকির পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। তখন সাবিনা তাঁর অণ্ডকোষ ধরে চাপ দেন। তিনি ছাড়তে বললেও ছাড়েননি। না ছাড়ায় তিনি দুই হাত দিয়ে স্ত্রীর গলা চেপে ধরেন। এরপরও না ছাড়লে তিনি স্ত্রীর গলা আরও জোরে চেপে ধরেন। স্ত্রীও জোরে চেপে ধরেন। এতে তিনি আরও জোরে চেপে ধরেন। কিছুক্ষণ পর সাবিনা হাত ছেড়ে দেন। তিনিও তাঁর গলা ছেড়ে দেন। দেখেন, স্ত্রী নিচে পড়ে গেছেন। তিনি ডাকলেও জবাব দেননি। পরে তুলে দেখেন, সাবিনা মারা গেছেন। পরে ঘর থেকে বের করে আমগাছের পাশে মাটিতে লাশ রেখে সারা দেহে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্বাসকষ্টের কারণে মৃত্যু হয়েছে। পরে লাশ পোড়ানো হয়েছে। পুলিশ তদন্ত শেষে আব্দুস সালামকে একমাত্র আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। বিচারিক আদালত ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি সাবিনা হত্যা মামলার রায়ে সালামকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) পাঠানো হয় হাইকোর্টে। অন্যদিকে খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন সালাম। শুনানি শেষে বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর বেঞ্চ ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি রায় দেন। রায়ে আসামি সালামকে খালাস দেওয়া হয়। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর সম্প্রতি তা সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
হাইকোর্ট রায়ে বলেন, যৌনাঙ্গ (পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোষ) একজন পুরুষের সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গ এবং সেখানে কোনো সহিংসতা ঘটলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ভীত হয়ে পড়ে। এখানে ভিকটিম (সাবিনা) শক্তি দিয়ে দণ্ডিতের যৌনাঙ্গে চাপ প্রয়োগ করে সহিংসতা ঘটায়। অভিযুক্ত বারবার অনুরোধ করলেও কর্ণপাত করেনি। স্ত্রীর আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা অধিকার প্রয়োগের সময় এটি ছিল একটি দুর্ঘটনা। ভিকটিমের মৃত্যু সম্পর্কে আসামিপক্ষের বক্তব্য বা স্বীকারোক্তিকে আসামির বক্তব্য প্রসিকিউশনের ব্যাখ্যার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। দণ্ডিত ব্যক্তি তার আত্মরক্ষার দাবি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। সে জন্য দণ্ডবিধির ১০০ ধারার সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। ওই অপরাধ কোনোভাবেই দণ্ডবিধির ৩০০ ধারার অধীনে ‘খুন’-এর সংজ্ঞার মধ্যে আসে না। ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত রায় এবং দণ্ডাদেশ বাতিল করা হলো।
হাইকোর্ট রায়ে বলেন, একজন ব্যক্তির আত্মরক্ষা করার অধিকার রয়েছে, যখন সে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয় বা এই ধরনের আঘাতের আশঙ্কা থাকে। রায়ে আরও বলা হয়, দণ্ডিত ব্যক্তি ঘটনা গোপন করার জন্য লাশে আগুন দিয়ে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় অপরাধ করেছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ওই ধারায় কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। এই ধারায় অভিযোগ গঠন করলে তাঁকে এই ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা যেত এবং সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া যেত। কিন্তু তিনি ১২ বছরের বেশি কারাগারে রয়েছেন, এর মধ্যে ৫ বছরের বেশি সময় কনডেম সেলে রয়েছেন।
হাইকোর্টে সালামের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মো. মোজাম্মেল হক ও সাকিব মাবুদ। জানতে চাইলে সাকিব বলেন, ‘যত দূর জানি, ওই খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেনি।’ রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী শাহানারা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘আপিল করার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে নোট দিয়েছিলাম। এরপর কী হয়েছে, আমার জানা নেই।’