সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক পরিবেশ যে জরুরি, সেটা আগে থেকেই বলে আসছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। নির্বাচনে কমিশন আয়োজিত আলোচনা ও পর্যালোচনা সভায় সুধীজনদের সামনে এবার তিনি স্বীকার করলেন, নির্বাচন কমিশন কঠিন অবস্থায় আছে। সিইসি আরও বলেছেন, ‘সংকট আছে, সেই সংকট নিরসন করতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের। আমরা বারবার বলেছি, রাজনীতিবিদরা যদি আমাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে না দেন, তাহলে আমাদের পক্ষে নির্বাচন করাটা কষ্টসাধ্য হবে। আর যদি পরিবেশ অনুকূল করে দেন, তাহলে কাজ সহজ হবে।’ গতকাল বুধবার ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনা ও পর্যালোচনামূলক সভায় আমন্ত্রিত সুধীজনরাও বলেছেন, বর্তমানে যে বাস্তবতা বিরাজ করছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন করা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে সম্ভব নয়। ইসির ক্ষমতার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ দেখা যায় না। নির্বাচন ভবনে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সমস্যা নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা চলে। এতে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সাবেক নির্বাচন কমিশনার, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, সাবেক সচিব, সাবেক রাষ্ট্রদূত, গণমাধ্যম সম্পাদক, নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা অনেকে অংশ নেন। উপস্থিত ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিব, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক, আইডিয়া দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পের পরিচালক, ইসির সিস্টেম ম্যানেজার ও যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা।
সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনটা ভালো হবে কি না, সেটা নির্ভর করছে পলিটিক্যাল উইলের (রাজনৈতিক সদিচ্ছ) ওপর। আন্তরিক পলিটিক্যাল উইল থাকতে হবে। এটা আমার থেকে আসবে না। পলিটিকস (রাজনীতি) থেকে আসতে হবে বা সরকার থেকে আসতে হবে।’ সমঝোতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি একটা সমঝোতার কথা, আপনারা চায়ের টেবিলে বসেন। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন হয়েছে, কেউ কারও সঙ্গে বসতে চাচ্ছেন না। ইসি এ সমস্যার সমাধান করে না। দুঃখজনক হলো, সে ধরনের সিভিল সোসাইটিও দেখতে পাচ্ছি না।’
আপেক্ষ করে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আজ দলগুলো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত।’
সুধীজনদের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা জানতে আগ্রহের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাচ্ছি। আলোচনা কাজে আসুক, এ প্রত্যাশা আমাদের।’
সিইসি বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন। এতে রাজনৈতিক দল, ভোটার, গণমাধ্যম, প্রবাসী বাংলাদেশিরা সবাই তাকিয়ে আছেন। কূটনৈতিক মহলেও ব্যাপক আগ্রহী। নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর।’ প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে কয়েকবার সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর আগে কোনো সরকার কখনো এমন প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এই প্রথমবার সরকারপ্রধান এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এজন্য আমি বলব আস্থা রাখতে চাই।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘আমাদের দেশে মাস্তান ও পেশিশক্তি আছে। এর ফলে প্রিসাইডিং অফিসাররা অসহায় হয়ে পড়েন। আমরা নির্বাচন বাতিল করতে পারব। তবে যার জন্য নির্বাচন বাতিল হবে সে আর নির্বাচন করতে পারবে না।’
যেসব সমস্যা তুলে ধরলেন সুধীজনরা : সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘জামালপুরের মতো ডিসিদের (জেলা প্রশাসক) বিরুদ্ধে আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জামালপুরের ডিসি বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় আনতে হবে। এ খবর সব পেপারে দেখলাম। এদের দিয়ে ক্রেডিবল (বিশ্বাসযোগ্য) নির্বাচন হবে না। এসব ডিসির বিরুদ্ধে আপাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কী করবেন। কীভাবে কাজ করবেন। এক জেলায় চারজন রিটার্নিং কর্মকর্তা দিয়ে নির্বাচন করাতে পারবেন। একই ডিসিদের রিটার্নিং করতে হবে বিষয়টি এমন নয়।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘কয়েক দিন আগে মালদ্বীপে ভোট হয়েছে, বড় বড় অবজারভার সেখানে ছিল। আপনাদের (ইসি) হাত-পা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আপনারা একা সিদ্ধান্ত নেবেন। কোনো পলিটিক্যাল পার্টির কথা শুনবেন না। অতীত ভুলগুলো শোধরাবেন।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, ‘বিদেশি রাষ্ট্রগুলো আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করছে। আমরাই এদের ডেকে এনেছি। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র আমাদের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে এর মাশুল দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের হাতে ক্ষমতা থাকার পরও গাইবান্ধা নির্বাচনে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সেখানে পক্ষপাতের অভিযোগ করা হলে তা ভুল হবে না। পরামর্শগুলো গ্রহণ করেনি। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই।’
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমরা মুখে শুধু বলি নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাবান, কিন্তু বাস্তবে কিছুই নেই। সংকট এতই কঠিন যে, সব দায় কমিশনের ওপর দিয়েও লাভ নেই।’ ইসির উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা সবার থেকে পরামর্শ শুনছেন কিন্তু পরামর্শ বাস্তবায়ন করতে পারেননি। না পারার কারণ আপনাদের ব্যাখ্যা করা দরকার। আপনারা প্রিসাইডিং অফিসারের ক্ষমতার কথা বলছেন যে, সুষ্ঠু পরিবেশ মনে না হলে সব ফেলে তিনি চলে আসবেন। প্রিসাইডিং অফিসারের ঘাড়ে কয়টা মাথা যে তিনি সবকিছু ফেলে চলে আসবেন?’
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেছেন, ‘বাস্তবতা আপনাদের (ইসি) অনুকূলে নেই। সরকার না চাইলে কমিশনের পক্ষে ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়। এখনো গাইবান্ধা নির্বাচনে অনিয়মে দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, ‘এখানে প্রধান চ্যালেঞ্জ সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করা। এ ছাড়া গণতন্ত্র না থাকলে এমন নির্বাচন অর্থহীন।’
ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘বাস্তবে নির্বাচন ব্যবস্থা বিশ্বাসহীনতায় রয়েছে। একটা ভালো নির্বাচন হলেই যে সব সমস্যা সমাধান হবে তা নয়। তবে ভালো নির্বাচন সমাধানের সূচনা হতে পারে। রাষ্ট্রদূতদের লাই দিতে দিতে বিদেশিদের টেনে আনি। এর ফল কী, তা আমরা জানি?’
আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক আশিষ সৈকত, আরটিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আশিক রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান, খবর সংযোগ সম্পাদক শেখ নজরুল ইসলাম, নাগরিক টিভির হেড অব নিউজ দীপ আজাদ, সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল, সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাস গুপ্ত, সময় টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ জুবায়ের, মাছরাঙা টেলিভিশনের হেড অব নিউজ রেজোয়ানুল হক রাজা, গাজী টিভির হেড অব নিউজ ইকবাল করিম নিশান, আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকার প্রমুখ।