ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে সনাতন ধর্মাবলম্বী জেলে সম্প্রদায়ের লোকজনকে বিয়ে করতে হলে ১৯ বার মোড়লদের অনুমতি নেওয়ার প্রথা রয়েছে। সম্প্রতি মোড়লদের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করায় একটি পরিবারকে একঘরে করা হয়েছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা মোড়ল প্রথার বিলুপ্তি চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ঈশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকার ধামদী গ্রামে অন্তত ৭০ জেলে পরিবারের বসবাস। গত ১৬ জুলাই মনোরঞ্জন বর্মণের ছেলে পুণ্য বর্মণকে বিয়ে করানো হয়। কিন্তু বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাওয়ার আগে পাড়ার মোড়লদের অনুমতি নেয়নি পরিবারটি। তবে পাড়া থেকে একজনকে সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল। পাত্রী দেখতে গিয়ে বিয়ে ঠিক হয়। পরে সমাজের মোড়লদের জানাতে গিয়ে তাঁরা তোপের মুখে পড়েন।
অভিযোগে বলা হয়, পুণ্য বর্মণের বিয়ের পাকা কথা অনুমতি ছাড়া নেওয়ায় মোড়ল অবনি বর্মণ ও সহকারী মোড়ল মঙ্গল বর্মণ আপত্তি তোলেন। বুঝিয়ে বলার পরও মোড়লেরা সাত দিন পর সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা জানান। মোড়লদের আবদার মেনে না নিয়ে পুণ্য বর্মণের বিয়ে সম্পন্ন করায় পরিবারকে একঘরে করার সিদ্ধান্ত হয়। যদি এ সিদ্ধান্ত কেউ না মানে, তবে তাকেও একঘরে করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
বিয়েতে অংশ নেওয়া পুণ্য বর্মণের মামা প্রীতিষ ভৌমিক ও মুক্তি ভৌমিকের পরিবারকেও একঘরে করে রাখা হয়। তারা গত ১৬ আগস্ট পঞ্চায়েত বৈঠকে ক্ষমা চেয়ে সমাজের সঙ্গে মিলে যায়। তবে এ সময় সিদ্ধান্ত হয়, মনোরঞ্জন বর্মণের পরিবার একঘরেই থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করে মুক্তি ভৌমিক বলেন, তাঁর ভাগনেরা সমাজের অনুমতি ছাড়া কাজ করেছে বলে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জেলেপাড়ায় গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিয়ে করতে মোড়লদের কাছ থেকে ১৯ বার অনুমতি নিতে হয়। পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় মোড়লের অনুমতি নিয়ে তাঁর প্রতিনিধিসহ পাত্রীর বাড়ি যেতে হয়। পাত্রী পছন্দ হলে মোড়লের অনুমতি নিয়ে পাকা কথা বলে উলুধ্বনি দিতে হয়। বিয়ে ঠিক হলে মহল্লার প্রতি ঘর থেকে প্রতিনিধি এলে সবাইকে ডেকে মোড়লকে জোড় হাত করে বিস্তারিত বলতে হয়। পাত্রী পক্ষ, পাত্র পক্ষের কেউ বাসায় এলে মোড়লকে আবার জানাতে হয়। বউভাতের দিন রান্না শুরু করার আগে মোড়লের অনুমতি নিয়ে চুলায় আগুন দিতে হয়। এভাবে সব মিলিয়ে ১৯ বার অনুমতি নেওয়ার প্রথা রয়েছে।
বাড়িতে গেলে ভুক্তভোগী মনোরঞ্জন ও তাঁর স্ত্রী সুর ধনী বর্মণ বলেন, আত্মীয়দেরও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। তাঁরা বলেন, দেশে প্রচলিত আইন থাকলেও এখানে রয়ে গেছে কুসংস্কার ও স্বেচ্ছাচারিতা। এই কুপ্রথার বিলুপ্তি চেয়ে আজ বুধবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা।
এলাকার মোড়ল অবনি বর্মণ ও সহকারী মোড়ল মঙ্গল বর্মণকে পাওয়া যায়নি। তবে অবনি বর্মণের ছেলে বাদল বর্মণ বলেন, নিয়ম না মেনে পরিবারটি অপরাধ করেছে। তারা ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে আবার সমাজে নেওয়া হবে।
পঞ্চায়েত সদস্য সুবল চন্দ্র বর্মণ বলেন, যুগ যুগ ধরে চলা নিয়ম ভেঙে মনোরঞ্জনরা অন্য ৭০ ঘর পরিবারকে একঘরে করে দিয়েছে।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘মোড়লদের সামাজিক প্রথা এখানে রয়েছে। কিন্তু পাত্রী দেখার অনুমতি না নেওয়ায় একঘরে করে দেবে–তা সমর্থন করি না। বিষয়টি জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
এ বিষয়ে ঈশ্বরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. আব্দুস ছাত্তার বলেন, ‘আদিম যুগের কুপ্রথা আমার পৌরসভায় এখনো প্রচলিত আছে, জানতাম না। মোড়লের অনুমতি না নিয়ে পাত্রী দেখায় এক মাসের বেশি সময় ধরে একটি পরিবারকে একঘরে করে রাখার বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। বিষয়টি নিয়ে আমি স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সব ক্ষেত্রে আইনের শাসন চলায় মোড়ল বা পঞ্চায়েত প্রথা চালু রাখার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’