সারাদেশের ন্যায় শেরপুরের নকলায় ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার শান্তিপূর্ণভাবে এইচএসসি, আলিম ও সমমানের প্রথম দিনের পরীক্ষা শেষ হলেও, বাকী পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে ও ফলাফল বির্পয়ের শঙ্কায় পড়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়া ৪ পরীক্ষর্থী। সড়ক দুর্ঘটনা কবলিত আশাহত পরীক্ষার্থীরা হলো- উপজেলার সরকারি হাজী জালমামুদ কলেজের বানিজ্য শাখার মীর সাব্বীর ও শুভ মিয়া এবং মানবিক শাখার রুবেল মিয়া ও মানিক মিয়া। এদের মধ্যে মীর সাব্বীরের অবস্থা গুরুতর।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে পার্শবর্তী উপজেলা নালিতাবাড়ীতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনা কবলিত হয় তারা। পরে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে পরীক্ষার আসনে বসলেও তাদের পরীক্ষা আশানুরূপ হয়নি। মীর সাব্বীরের শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় সে বাকী পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে মহাচিন্তায় আছে। তাছাড়া আহত বাকিরা পড়েছে তাদের ফলাফল বির্পয়ের শঙ্কায়।
অভিভাবকরা জানান, নিজ উপজেলা শহরে যথেষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও অজ্ঞাত কারনে হঠাৎ করেই ২০১৫ সাল থেকে হাজী জালমামুদ কলেজের পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র চৌধুরী ছবরুন নেছা মহিলা কলেজ কেন্দ্রের বদলে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরের নালিতাবাড়ী উপজেলার শহীদ নাজমুল স্মৃতি কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এতে করে প্রতি বছর পরীক্ষা চলাকালে কোন না কোন দিন দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হচ্ছে তাদের। অন্যদিকে গ্রামের দরিদ্র অভিভাবকদের গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা, নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মূল্যমান সময়, মানসিক চাপে থাকতে হচ্ছে কোমলমতী পরীক্ষার্থীদের। এসব বিবেচনায় নিজ উপজেলার চৌধুরী ছবরুন নেছা মহিলা কলেজ কেন্দ্র পুনরায় বহালের দাবি উঠেছে। অগণিত ফেইসবুক ব্যবহারকারী নিজ নিজ টাইম লাইনে নিজ উপজেলার কেন্দ্র পুনর্বহালের দাবী জানানোর পাশাপাশি অজ্ঞাত কারনে কেন্দ্র পরিবর্তনের উপযুক্ত কারন জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
এক পরীক্ষার্থী তার টাইম লাইনে বলে- “আগে নাকি হাজী জালমামুদ এর শিক্ষার্থীরা ছবরুন নেছায় এক্সাম দিতো। তারপর কিছু বিষয়ের রেশ ধরে কলেজ কর্তৃপক্ষ নালিতাবাড়ীকে পরিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে চেয়ে আবেদন জানিয়েছিল এবং তারা সফল হয়েছে। কিন্তু এই সফলতা শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে ফেলেছে। যাতায়াত সমস্যা, সময়ের অপচয়সহ সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। অবশেষে আজকের ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রচলিত সিস্টেমের প্রতি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি”। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানান প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনেরর দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সর্বসাধারন।
দুর্ঘটনার পরে চৌধুরী ছবরুন নেছা মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শহিদুল ইসলাম তাঁর টাইম লাইনে লেখেন- পরীক্ষার্থীদের আহত হওয়া ঘটনা সত্যিই খুব দুঃখজনক। আহত শিক্ষার্থীর প্রতি সমবেদনা জানাই, দোয়া করি তারা যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে এবং পরবর্তী পরীক্ষা গুলোতে ভালভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। একই সাথে প্রশাসনের কাছে দাবি, শিক্ষার্থীদের কোন ধরণের সুবিধা দেয়ার জন্যে অথবা কোন লাভে নকলা-নালিতাবাড়ীর পরীক্ষার্থীদের এই ধরণের দুর্ভোগ এবং দূরাবস্থা তৈরি করা হয়েছে তার কারণ যেন অনুসন্ধান করা হয়। উভয় উপজেলাতেই পরীক্ষার্থীদের ইন্টার-চেঞ্জের জন্যে (এক কলেজের পরীক্ষার্থীদের অন্য কলেজে পরীক্ষা দেয়ার) উপযুক্ত সংখ্যক কলেজ বিদ্যমান থাকার পরেও কোন উদ্দেশ্যে হাজী জালমামুদ এবং নাজমুল স্মৃতি কলেজ কর্তৃপক্ষ এই অস্বাভাবিক ব্যবস্থা তৈরি করলেন তার ব্যখ্যা জানা প্রয়োজন। এটা কি সরকারের নির্দেশে হয়েছে? নাকি কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবির প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন এই উক্ত ব্যবস্থার সম্মতি দিয়েছেন তাও জানা দরকার। নিজেরা যদি দাবি করে থাকেন তাহলে তার পিছনে স্বার্থ বা যুক্তিটা কি ছিল? তাও জানা উচিত। পরীক্ষার্থীরা কি তাই চেয়েছিল? যদি না চেয়ে থাকে, তারাই বা এর প্রতিবাদ করে নাই কেন? নাকি উভয় কলেজের মধ্যে কোনো অলিখিত আশ্বাসের বিনিময়ে এই বন্ধন তৈরি হয়েছে? যাতে পরীক্ষার্থীরা নিজেদেরকে লাভবান করার সুযোগ পেয়ে এই কষ্ট বা দুর্ভোগ মেনে নিয়েছে। নাকি কর্তৃপক্ষ মেনে নিতে বাধ্য করেছেন নিজেদের অন্যকোনো উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্যে? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। আজকে বড় ধরনের দূর্ঘটনার ঘটে যাওয়ার জন্যে হয়ত বিষয়টা অনেকের সামনে এসেছে, অনেকেই অনেক মন্তব্য করছেন। কিন্তু আমি বিষয়টা নিয়ে বেশ কয়েক বছর আগেই একটি পোষ্ট করেছিলাম। বলেছিলাম এই সবকিছুর পিছনে শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর অসৎ প্রতিযোগিতার মানসিকিতা কাজ করে। যারা কলেজ পরিচালনায় অথবা শ্রেণী কার্যক্রমে নিজ দায়িত্ব যথাযথ অথবা সঠিক ভাবে পালন করেন না কিন্তু নিজ কলেজের রেজাল্ট ভাল দেখাতে চান তারাই সাধারণত বিকল্প ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবেন। তার ফলশ্রুতিতেই এইসব অনাকাঙ্খিত ব্যবস্থা ও অবস্থার সৃষ্টি হয়। মনে রাখা প্রয়োজন, ইন্টার-চেইঞ্জের প্রয়োজন কেন পড়েছিল? নিজ কলেজের ফলাফল ভাল দেখানোর জন্যে শিক্ষকরা যখন নিজ কলেজের শিক্ষার্থীদের অনৈতিক কাজে (নকল করার) সহযোগিতা শুরু করলেন তখন সরকার বাধ্য হয়ে শিক্ষকদের নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা নেওয়ার রীতি বন্ধ করে দিয়ে, অন্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার নিয়ম চালু করে। এতেও আমরা দমে যাইনি, বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আন্ডারস্টেনডিং তৈরি করে পরীক্ষার্থী বদল ঠিকই করছি, কিন্তু উদ্দেশ্যের বদল যেন না ঘটে। এই উদ্দেশ্য বদল না হওয়ার বলি আজকের দূর্ঘটনা, হয়ত মারাত্মক আরও কিছু ঘটতে পারত। এছাড়াও, ছেলে মেয়েদের এতদূরে গিয়ে পরীক্ষা দেয়ার দুর্ভোগই কি কম? সময় এসেছে এসব স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে কথা বলার। শুধু এই দুই কলেজই না, পাশের আরেকটা কলেজ নিকটবর্তী নিজ উপজেলার কলেজ রেখে দূরবর্তী জেলা শহরের কলেজে কেন চলে গেল? তার কারনও অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। কারণ, সেটাও অস্বাভাবিক স্থানান্তর বলে অনেকে মনে করছেন। ওই কলেজের অন্যত্র গমন যে নিজ ইচ্ছায়, তা নিশ্চিত।
মো. মাসুম মিয়াসহ অনেক শিক্ষার্থী আক্ষেপ করে বলে- এতবড় দুর্ঘটনা ঘটে গেলো অথচ কলেজের কোন শিক্ষক আহত পরীক্ষার্থীদের কোন খোঁজ খবর নিলেন না। মাসুম মিয়া জানায়, মীর সাব্বিরের ডান হাতে বেশি আঘাত পাওয়ায় তার পক্ষে নিজ হাতে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই কলেজের শিক্ষকদের কাছে পরামর্শ ও সহযোগিতা কমনা করলেও নাকি কোন প্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়নি। উল্টো কলেজ কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এবিষয়ে তাদের কিছুই করার নেই! তাহলে এই দুর্ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের দায় কে নিবে? তাদের কোন অপরাধের জন্য এমন ঝুঁকিতে থাকতে হচ্ছে? এমন প্রশ্ন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষানুরাগীদের।
চন্দ্রকোনা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল কালামা অজাদ বলেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ লাগবে প্রয়োজনে সরকারি হাজী জালমামুদ কলেজের পরীক্ষার্থীদের চন্দ্রকোনা কলেজে এবং চন্দ্রকোনা কলেজের পরীক্ষার্থীদের সরকারি হাজী জালমামুদ কলেজকে কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ধুকুড়িয়া এ-জেড টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ রেজাউল আলম বলেন, সরকারি হাজী জালমামুদ কলেজের বিএম শাখার পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা নকলা সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়। এতে কোন সমস্যা হচ্ছেনা। প্রয়োজনে বিজ্ঞান, মানবিক ও বানিজ্য শাখার পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা নকলা সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে নেওয়া যেতে পারে। তাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ লাগব হবে বলে তিনি মনে করেন।
চৌধুরী ছবরুন নেছা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক বলেন, কেন আমাদের কলেজ থেকে কেন্দ্র সড়িয়ে নেওয়া হয়েছিলো তার কারন জানানেই। তবে হাজী জালমামুদ কলেজের পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র চৌধুরী ছবরুন নেছা মহিলা কলেজ কেন্দ্রের বদলে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরের নালিতাবাড়ী উপজেলার শহীদ নাজমুল স্মৃতি কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীর জন্য অনেকটাই কঠিন বিষয়। তাছাড়া গ্রামের অভিভাকদের গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা, নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মূল্যমান সময়, মানসিক চাপে থাকতে হচ্ছে কোমলমতী পরীক্ষার্থীদের। এসব বিবেচনায় নিজ উপজেলার কেন্দ্র পুনরায় বহালের দাবির সাথে তিনিও ঐকমত্য পোষন করেছেন।
এবষিয়ে হাজী জালমামুদ কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ লূৎফর রহমান জানান, কোন এক সময় সরকারের নির্দেশ মোতাবেক (কলেজ ইন্টার চেন্স) হাজী জালমামুদ কলেজের পরীক্ষার্থীরা চৌধুরী ছবরুন নেছা মহিলা কলেজে এবং চৌধুরী ছবরুন নেছা মহিলা কলেজের পরীক্ষার্থীরা হাজী জালমামুদ কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতো। কিন্তু তখনকার পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চাহিদা অনুযায়ী এবং পরিবেশগত কারনে ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক কেন্দ্র পরিবর্তন করা হয়েছিলো। এখন উপযুক্ত পরিবেশ সৃস্টি হওয়ায় নিজ উপজেলার কেন্দ্র পুনরায় বহাল করা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।