নাটোরের সিংড়ায় একসঙ্গে এসএসসি পাশ করলেন মা-ছেলে। মা লিপি আক্তার জিপিএ-৪.৫৪ এবং ছেলে লিয়াকত হোসেন (১৬) জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
শুক্রবার (২৮ জুলাই) এসএসসির ফল প্রকাশের পর মা-ছেলে এ ফলাফল অর্জন করেন। তারা পার্শ্ববর্তী সিংড়া উপজেলার সোনাপুর গ্রামের বাসিন্দা। এছাড়া লিপি আক্তার সিংড়ার চামারী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য।
জানা যায়, ছেলে লিয়াকত হোসেন গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে পেয়েছেন জিপিএ-৫ এবং তিনি সিংড়া চককালিকাপুর কারিগরি স্কুল ও কলেজে থেকে পরীক্ষা দিয়ে পেয়েছেন জিপিএ-৪.৫৪ পয়েন্ট। একসঙ্গে মা ও ছেলের এসএসসি পাশ করায় এলাকার মানুষজন অনেক খুশি এবং এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
লিপি আক্তার সিংড়া উপজেলার চামারী ইউনিয়নের সংরক্ষিত ১,২,৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য ও ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি। পাশাপাশি সেলাই প্রশিক্ষক হিসাবে তার বেশ পরিচিতি রয়েছে। বাবার বাড়ি সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর উপজেলার খুকনি গ্রামে। বিয়ের পর স্বামী-সংসার নিয়ে ভালোই দিন কাটছিল তার। তাদের ঘরে দুই মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান রয়েছে। তারা লেখাপড়া না জানলেও ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখায় বেশ উৎসাহী ছিলেন।
ইউপি সদস্য লিপি আক্তার বলেন, খুব ছোট বেলা থেকেই পড়ালেখা করার প্রবল ইচ্ছে ও স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বাবার আর্থিক দীনতায় সেই সুযোগ হয়ে ওঠেনি তার। এজন্য খুব অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে তাকে। ২০০০ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পরপরই নাটোরের সিংড়া উপজেলার চামারী ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের লোকমান হোসেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। স্বামীর অনুপ্রেরণায় ছেলে লিয়াকতের সঙ্গে স্কুলে ভর্তি হই। পাঁচ বছর আগে স্বামী লোকমান মারা যাওয়ায় চরম অর্থকষ্টের মধ্যে পড়েন। তবুও হাল ছাড়িনি। সন্তানের সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। শুক্রবার দুপুর এসএসসি পাসের খবর শুনে আনন্দে চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে। ফল প্রকাশের পর আশপাশের মানুষ দেখতে আসছেন। অভিনন্দন জানাচ্ছেন।
লিপি আক্তার আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, ছোটবেলার ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত ছেলের সঙ্গে পড়াশুনা আর পরীক্ষা দিয়ে পূরণ হল। খুব আনন্দ লাগছে। তবে এই আনন্দ আরও বেশি হতো,যদি স্বামী বেচে থাকতেন। তিনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কারণ তার প্রেরণায় আজ এই অর্জন। আগামীতে সন্তানদের পাশাপাশি তিনিও লেখা পড়া চালিয়ে যেতে চান।
ছেলে লিয়াকত হোসেন বলেন, তার মা ২০২২ সালে চামারী ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার একটি সেলাই প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে। তিনি একজন উদ্যোক্তা হিসেবে অন্য নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেন। পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি হিসাবে এলাকার মানুষের খোঁজ খবর নেওয়া, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ এবং এক হাতে সংসার সামলানো সেইসঙ্গে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ায় আমি বিস্মিত হয়েছি। মা আমাদের মানুষ করতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন। তিনি এসএসসি পাশ করায় খুব খুশি হয়েছি এবং নিজের পড়াশুনার পাশাপাশি মায়ের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে সহায়তা করতে চান।
সোনাপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোশারফ হোসেন বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর লিপি সন্তানদের জন্য মা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং নিজেও একজন সফল শিক্ষার্থী হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। স্বামীর মৃত্যুর তিনি শোককে শক্তিতে পরিণত করে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেও শিক্ষিত হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তিনি এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। আমরা তার জন্য গর্ববোধ করি। তার সাফল্য কামনা করি।
চামারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান স্বপন মোল্লা বলেন, লিপি আক্তার আমাদের পরিষদের গর্ব। তাদের মা ছেলের পাশের খবরে এলাকার সবাই খুব আনন্দিত। তিনি তার মেধা ও পরিশ্রমের ফল পেয়েছেন। আমি তার আরও সফলতা কামনা করি। আমরা পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি।