জ্বরে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির ডেঙ্গু হয়েছে কি না, এটা উপসর্গ দেখে বোঝার চেয়ে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা এখন অনেক সহজ। কারণ ডেঙ্গুর যে ক্লাসিক্যাল উপসর্গ যেমন—হঠাৎ প্রচণ্ড জ্বর (১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট), প্রচণ্ড শরীর ব্যথা, বিশেষ করে চোখের পেছনে ব্যথা, শরীরে লাল র্যাশ ইত্যাদি উপসর্গগুলো এখন আর তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর জন্য ডেঙ্গু ভাইরাসের জেনেটিক মিউটেশন (জিনের পরিবর্তন)-এর অন্যতম কারণ হতে পারে। তা ছাড়া উপসর্গ যখন আসে, তখন পরিস্থিতি জটিলও হতে পারে।
ভাইরাল ফিভার দিন তিনেকের মধ্যে কমতে থাকে, শরীরও ক্রমেই ভালোর দিকে যায়। কিন্তু ডেঙ্গু হলে এত সহজে নিষ্কৃতি মেলে না। তাই কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কি না তা জানতে এবং শুরু থেকেই ঝুঁকিমুক্ত থাকতে রক্তের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।
এসব রিপোর্ট রোগীকে দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে আক্রান্ত ব্যক্তিরা ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব রয়েছে এমন এলাকায় যদি বসবাস করেন অথবা এমন হয়, আক্রান্ত হওয়ার শেষ ১৪ দিনের মধ্যে ওই সব এলাকায় তাঁরা অবস্থান করেছিলেন, তাঁদের জ্বর হলে এসব রক্ত পরীক্ষা করা খুব জরুরি।
কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি)
কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট বা সিবিসি পরীক্ষাটির মাধ্যমে ব্লাড সেল টাইপ এবং ব্লাড সেলের কাউন্ট বা পরিসংখ্যান জানা যায়। এসব দেখে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন ব্লাড সেল স্বাভাবিক কি না, শরীরে কোনো ইনফেকশন আছে কি না, রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কত ইত্যাদি।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের ক্ষেত্রে অনেক সময় রক্তে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার সংখ্যাও কমে যায়।
সিবিসি পরীক্ষায় প্লাটিলেট কাউন্ট ছাড়াও রক্তের শ্বেতকণিকা (ডাব্লিউবিসি), হেমাটোক্রিট বা এইচসিটি (লোহিত কণিকার সঙ্গে রক্তের পরিমাণের অনুপাত) সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্লাটিলেট কমে গেলে রক্ত ক্ষরণ হতে পারে সত্য; কিন্তু এরও অনেক আগে শ্বেতকণিকা (ডাব্লিউবিসি) কমে যেতে পারে এবং হেমাটোক্রিট বা এইচসিটি বেড়ে যেতে পারে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
বিশেষত জলীয় অংশ বা রক্তরস যখন রক্তনালি থেকে বের হয়ে আসে, তখনই হেমাটোক্রিট বা এইচসিটি বাড়া শুরু হয়। তাই জ্বর হওয়ার পরপরই (প্রথম দিন) এই পরীক্ষাটি করা উচিত।
এনএস ওয়ান এন্টিজেন
কারো শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে কি না তা বোঝা যায় NS1 (Nonstructural Protein 1) এন্টিজেন রক্ত পরীক্ষাটির মাধ্যমে। জ্বরের উপসর্গ দেখা দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে থেকে তিন দিন পর্যন্ত এই এন্টিজেন শরীরে পাওয়া যায়। কিন্তু জ্বর আসার তিন দিন পর এই পরীক্ষাটি করে খুব একটা লাভ হয় না। কারণ তখন শরীরে ওই এন্টিজেন ধরা দেয় না।
তাই কারো জ্বর হওয়ার প্রথম দিন বা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই পরীক্ষাটি করিয়ে নেওয়া ভালো। সম্ভব না হলে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেও পরীক্ষাটি করানো উচিত।
এনএস ওয়ান এন্টিজেন পরীক্ষার রিপোর্ট পজেটিভ মানে হলো ডেঙ্গু পজেটিভ। তখন চিকিৎসকের পরামর্শে বা প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডেঙ্গুর যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে। আর যদি নেগেটিভ আসে, তবে সে অনুযায়ী জ্বরের অন্য চিকিৎসা দিতে হবে।
অ্যান্টিবডি (আইজিএম, আইজিজি)
শরীরে ডেঙ্গুর অ্যান্টিবডির উপস্থিতি রয়েছে কি না তা বোঝাতে রক্তের অ্যান্টিবডি Immunoglobulin M (IgM), Immunoglobulin G (IgG) পরীক্ষাগুলো করা হয়। তবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে এই পরীক্ষা করানো হলে ডেঙ্গু ধরা না পড়ারই কথা। জ্বর আসার চার দিন পরে ডেঙ্গুর আইজিএম পরীক্ষাটি করালে সেটাও নেগেটিভ আসার সম্ভাবনা বেশি।
ডেঙ্গু হলে মোটামুটি ৮-১০ দিনের একটা চক্র চলে। নিয়ম হচ্ছে, কারো জ্বর হওয়ার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ষষ্ঠ দিনের মাথায় এই পরীক্ষাটি করানো, যা ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত করা যায়। রক্তে আইজিএম পজিটিভ থাকলে বুঝতে হবে বর্তমানে রোগীর সংক্রমণ রয়েছে। আর রক্তে আইজিজি পজিটিভ থাকলে বুঝতে হবে আগে রোগীর সংক্রমণ ছিল এবং বর্তমানে সে দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। আর দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া মানে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং তখন বিশেষ সতর্কতা নিতে হবে।