দক্ষিণের দ্বীপ জেলা ভোলার গ্যাস এবার জেলার বাইরে যাচ্ছে। কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি) হিসেবে সিলিন্ডারে ভরে এই গ্যাস পৌঁছে দেওয়া হবে শিল্পকারখানায়। এ–সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব এখন সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এ মাসের মধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে মে মাসের শেষ দিকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হতে পারে।
গ্যাস–সংকটে ভুগতে থাকা গাজীপুর, ভালুকার বিভিন্ন শিল্পকারখানায় শুরুতে এই গ্যাস সরবরাহ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শিল্পগ্রাহকেরা বর্তমানে পাইপলাইন থেকে প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাস পান ৩০ টাকায়। আর সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস বিক্রি হয় ৪৩ টাকায়। প্রস্তাব অনুসারে, ভোলার গ্যাস সিলিন্ডারে করে কারখানায় পৌঁছে দেওয়া হবে ৪৬ টাকা ৬০ পয়সায়।
ভোলায় গ্যাস উৎপাদনের কাজটি করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)। আর বাপেক্সের কাছ থেকে কিনে নিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে তা সরবরাহ করে সুন্দরবন গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। সুন্দরবনের কাছ থেকে কিনে নিয়ে শিল্পে গ্যাস সরবরাহের কাজটি করতে পারে সিএনজি খাতের কোম্পানি ইন্ট্রাকো।
সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি সূত্র বলছে, ভোলা থেকে সিলিন্ডারে করে গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে চারটি কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এগুলো হলো ইন্ট্রাকো সিএনজি, পার্কার বাংলাদেশ, হাওলাদার বাংলাদেশ ও সুপার গ্যাস। প্রাথমিকভাবে ইন্ট্রাকো সিএনজিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। ভোলায় একটি সিএনজি স্টেশনের জন্য আগে থেকেই অনুমোদন নেওয়া আছে ইন্ট্রাকোর। গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইনও তৈরি করা আছে।
যদিও স্টেশনটি চালু হয়নি। পাইপলাইনের গ্যাস সিএনজি করে সিলিন্ডারে ভরার কম্প্রেসর স্টেশন বসানো আছে এখানে। পর্যাপ্ত জমিও আছে তাদের। তাই সরবরাহ শুরু করতে খুব বেশি দেরি হবে না। বর্তমান কাঠামো ব্যবহার করেই সিলিন্ডার সরবরাহ করতে পারবে তারা।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবটি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর গ্যাস সরবরাহের কাজ শুরু হবে।
সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি বলছে, চূড়ান্ত অনুমোদনের পর গ্যাস সরবরাহ শুরু করতে ইন্ট্রাকোর দুই মাস সময় লাগতে পারে। প্রাথমিকভাবে দিনে ৫০ লাখ ঘনফুট করে সরবরাহ শুরু হবে। সরবরাহ বাড়িয়ে দুই কোটি ঘনফুটে নেওয়ার চিন্তা আছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে আরও সাত থেকে আট মাস সময় লাগতে পারে।
১৯৯৫ সালে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বাপেক্স। একই সংস্থা ২০১৮ সালে আবিষ্কার করে ভোলার দ্বিতীয় গ্যাসক্ষেত্র ভোলা নর্থ। শাহবাজপুর থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয় ২০০৯ সালে। আর ভোলা নর্থ থেকে এখনো উৎপাদন শুরু হয়নি। দুটি গ্যাসক্ষেত্র মিলে এখন দেড় ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাসের মজুত থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পেট্রোবাংলা। নতুন কূপ খননের পর মজুত আরও বাড়তে পারে। চাহিদা না থাকায় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে না।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে দিনে ১২ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। চাহিদা অনুসারে এখন উৎপাদন করা হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত কোটি ঘনফুট। গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে প্রস্তুত আছে বাপেক্স। বিক্রি বাড়লে বাপেক্সের রাজস্ব বাড়বে। তাই উৎপাদন সক্ষমতা আরও বাড়ানো হচ্ছে।
লম্বা সময় ধরে গ্যাস–সংকটে ভুগছে সারা দেশ। দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। উৎপাদন হয় ২৩০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি মেটাতে ২০১৮ সাল থেকে চড়া দামের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করে সরকার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চড়া দামে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকলেও পড়ে আছে ভোলার গ্যাস।
শুধু উদ্যোগের অভাবে এটি যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়নি। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম নাগালের বাইরে যাওয়ার পর ভোলার গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানো নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। তবে ভোলার গ্যাস এলএনজি করে বাইরে আনা যাবে কি না, তা নিয়ে কোনো সমীক্ষা করা হয়নি।
শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের পরই নব্বইয়ের দশকে ভোলার গ্যাস জেলার বাইরে আনার প্রস্তাব দিয়েছিল বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিকল। ১২০ কিলোমিটার পাইপলাইন করার কথা বলেছিল তারা।
এ গ্যাস ব্যবহার করে ভোলা, বরিশাল ও খুলনায় বিদ্যুৎকেন্দ্র করারও প্রস্তাব দিয়েছে ইউনিকল, তবে তা নিয়ে এগোয়নি সরকার। এটি লাভজনক হবে না বলেই ধারণা ছিল তৎকালীন সরকারের। যদিও ভোলার গ্যাস পাইপলাইনে করে বাইরে আনার বিষয়ে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি এখন পর্যন্ত।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদা মেটাতে অনেক শিল্পকারখানা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে করে গ্যাস নেয়। এতে বাড়তি দামে গ্যাস কেনার পাশাপাশি পরিবহন খরচও নিজেদের দিতে হয়।
এ হিসেবে ভোলার গ্যাস কারখানায় পৌঁছে দিলে তৈরি পোশাক খাত, সিরামিক খাতের কিছু শিল্প উপকৃত হবে। আর এলএনজিতে রূপান্তর করে এনে পাইপলাইনে সরবরাহ করা গেলে সবাই সুফল পেত। তবে পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজিতে রূপান্তর সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। এখনই তা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, সিএনজি সিলিন্ডারে করে গ্যাস নিয়ে ছোট ছোট বয়লার চালানো যাবে। এটি বড় কারখানার তেমন কাজে লাগবে না। এলএনজি করে এনে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে পারলে বড় শিল্পও উপকৃত হতো।