কামিল পাস করে ১৯৭৪ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার তারাকান্দি ফাজিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন মো. সিরাজুল ইসলাম। ১৯৭৫ সালে তারাকান্দি আকন্দ বাড়ির জামে মসজিদের ইমাম মো. করম আলীর মৃত্যুর পর এলাকাবাসীর আহ্বানে বিনা পয়সায় ইমামতি শুরু করেন সিরাজুল।
৪৮ বছর ইমামতি করে ৭৫ বছর বয়সে বার্ধক্যের সমস্যার কারণে অবসর নিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় চার দশক তিনি বিনা পয়সার ইমামতি করেছেন। অবসরসংক্রান্ত বিদায়ে গ্রামবাসী তাঁকে জমকালো সংবর্ধনা দিয়েছেন।
পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামের বাসিন্দারা সিরাজুল ইসলামের বিদায়ে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করে স্মরণীয় করে রেখেছেন। তারাকান্দি আকন্দ বাড়ির জামে মসজিদের সামনে মুসল্লি ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে গত শুক্রবার বাদ জুমা সিরাজুল ইসলামকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ সময় তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় নগদ টাকা ও নানা উপহারসামগ্রী। পরে মোটরসাইকেল বহরে করে সিরাজুলকে বাড়ি পৌঁছে দেন গ্রামের যুবকেরা। সিরাজুল ইসলাম উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের মধ্য তারাকান্দি গ্রামের মৃত মিয়া হোসেনের ছোট ছেলে।
তারাকান্দি আকন্দ বাড়ির জামে মসজিদের কোষাধ্যক্ষ ফেরদৌস আলম বলেন, মাওলানা সিরাজুল ইসলাম দীর্ঘ ৪৮ বছর ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রায় ৪০ বছর কোনো বেতন নেননি। ইমামতি থেকে অবসর নেওয়ার পর গ্রামবাসী তাঁকে যা খুশি দিয়েছেন, তিনিও তা না গুনেই নিয়েছেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মসজিদ কমিটির সভাপতি ও মোতোয়ালি আফতাব উদ্দিন। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. এনামুল হকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ইউপি) বুলবুল আহমেদ, তারাকান্দি বাজার (ওয়াক্ফ) কমিটির মোতোয়ালি শফিকুল ইসলাম, তারাকান্দি বাজার বণিক সমিতির সভাপতি জাকির হোসেন প্রমুখ।
জাঙ্গালিয়া ইউপির সাবেক সদস্য মো. মিনহাজ উদ্দিন বলেন, একজন সাদা মনের মানুষ ইমাম সিরাজুল ইসলাম। একই মসজিদে এত বছর তিনি ইমামতি করছেন, অথচ কারও সঙ্গে তাঁর কোনো মনোমালিন্য হয়নি। তিনি বয়সের ভারে ইমামতি ছাড়তে চাইলেও গ্রামবাসী তাঁকে এত দিন ছাড়েননি।
গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইমাম সিরাজুল ইসলাম বার্ধক্যের করণে অবসর নিয়েছেন। গ্রামবাসী তাঁকে না জানিয়েই বিশাল আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তাঁরা চেয়েছিলেন এমন একজন মহৎ ব্যক্তির বিদায় অনুষ্ঠান যেন স্মরণীয় হয়ে থাকে। তাই তাঁরা সুসজ্জিত মঞ্চ করে বিদায় অনুষ্ঠানের অয়োজন করেন। সেখানে নানা বয়সী মানুষ স্মৃতিচারণা করেন।
গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে ইমাম সাহেবকে পবিত্র কোরআন শরিফ, ক্রেস্ট, নগদ টাকা, উপহারসহ নানা উপহারসামগ্রী দেওয়া হয়েছে। বিদায় সংবর্ধনা শেষে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়। এ সময় গ্রামের যুবসমাজ মোটরসাইকেল বহরে করে তাঁকে নিজ বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসেন।
এমন বিদায় সংবর্ধনায় অভিভূত সিরাজুল ইসলাম বলেন, অনেক কম বয়সে মসজিদটির ইমামতি শুরু করেছিলেন। তখন মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছিল। তাঁকে যাঁরা ইমামতিতে নিয়েছিলেন, সেসব মুরব্বিরা আজ আর বেঁচে নেই। তবে তাঁদের সন্তানেরা, গ্রামের অন্যরা তাঁকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। তিনি আরও বলেন, তিনি যখন মক্তবে পড়াতেন, তখন আশপাশের গ্রামে এত মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসা ছিল না। তাঁর ছাত্রছাত্রী কয়েক গ্রামজুড়ে রয়েছেন। তিনি অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর কোরআন শরিফ শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই আজ বড় বড় চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু তাঁরা তাঁকে ভুলে যাননি। তাঁকে ভালোবাসেন। গ্রামবাসী তাঁকে আরও ইমামতির দায়িত্ব পালনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তবে বয়স হয়ে যাওয়ায় নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত তিনি। তাই তাঁর পক্ষে আর দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যক্তিজীবনে তিনি তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ের বাবা।
মসজিদ কমিটির সভাপতি ও মোতোয়ালি মো. আফতাব উদ্দিন বলেন, সিরাজুল ইসলাম তাঁদের গ্রামেরই একজন। পরম আপনজন হয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর অভিভাবকের মতো।
জাঙ্গালিয়া ইউপির চেয়ারম্যান বুলবুল আহমেদ বলেন, একজন ইমাম সমাজের নেতা। তাঁর এমন সম্মান ও রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনা দিয়ে খুবই প্রশংসনীয় কাজ করেছেন এলাকাবাসী।