ভোলাসহ উপকূলবাসীর কাছে প্রতি বছর ১২ নভেম্বর এক আতঙ্কের নাম। কান্নার দিন। ১৯৭০ সালের এই দিনে ভোলায় ৫ লাখসহ উপকূলে মারা গেছে প্রায় ৮ লাখ মানুষ। ওই দিন লণ্ডভণ্ড হয়েছে জনপদ।
শনিবার দিনটি উদযাপনে দুর্যোগ মোকাবেলায় করণীয় পদক্ষেপ হিসেবে সিপিপি স্বেচ্ছাসেবকদের মহড়া, সাংস্কৃতিক পালাগান ও আলোচনার আয়োজন করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন। ৫২ বছর পর এই প্রথম দিনটি সরকারিভাবে পালন করা হয়েছে।
জেলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে দিনভর বিশাল আয়োজনে কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শিখা সরকার। অলোচনা সভায় জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক-ই লাহী চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত সচিব শিখা সরকার।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দুর্যোগ মোকাবেলায় সাহসি ভূমিকা রেখে চলেছে। সময়মতো পদক্ষে নেওয়ায় মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা পাচ্ছে। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অতিরিক্ত সচিব জানান, আশ্রয়ান ও গুচ্ছগ্রামের ঘরগুলোকে সাইক্লোন টাইপ (নিচতলা খোলা রেখে) পাকা ঘর নির্মাণ করা হলে, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় দুর্গম চরাঞ্চল থেকে সাধারণ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়ার ঝুৎকি থেকে রক্ষা পাবে। এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দফতরের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
এ সময় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিপির পরিচালক (প্রশাসন) আহমাদুল হক, ৭০-এর জলোচ্ছ্বাসের প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রথম ওই সংবাদ প্রকাশকারী বর্তমান প্রেসক্লাব সভাপতি এম হাবিবুর রহমান, প্রবীণ সাংবাদিক আবু তাহের, এলজিইডির নির্বাহী কর্মকর্তা ইব্রাহিম খলিল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিবেক সরকার, মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. ইউনুছ, রেডক্রিস্টে সোসাইটির সম্পাদক আজিজুল ইসলাম, কোস্টগার্ড কর্মকর্তা মো. মোসায়েম হোসেন, জেলা সিপিপি উপপরিচালক মো.আব্দুল রশিদ, চরফ্যাশন উপজেলার সিপিপি টিম লিডার মো. জসিম উদ্দিন প্রমুখ।
ভোলা প্রেস ক্লাবের বর্তমান সভাপতি এম হাবিবুর রহমান জানান, ১৯৭০ সালের ওই দিন সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। সন্ধ্যায় বাতাস শুরু হয়। বলা যায় রাত ১০টায় মহাতাণ্ডব শুরু হয়। ওই সময় ছিল না এমন সাইক্লোন শেল্টার। ছিল না আবহাওয়া দফতরের তথ্য প্রচারের ব্যবস্থা। রাত ১২টায় ১০ ফুট উচ্চতায় মেঘনার পানির চাপে ভাসিয়ে নিয়ে যায় লাখ লাখ মানুষকে। ভেঙে পড়ে ঘরবাড়ি, গাছপালা।
ওই দিন বাবা-মাসহ ১০০ জন স্বজন হারান বর্তমান ওবায়দুল হক কলেজের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল বাছেদ। কেউ হারান বাবাকে, কেউ মাকে, কেউ সন্তানকে এমন অসংখ্য স্বজনহারারা এখন সেই দিনকে স্মরণ করে, ঝড়ের খবর পেলে আঁতকে ওঠেন। হাবিবুর রহমানের খেলা ওই দিনের ওই ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদনটি ৪দিন পর একটি মালটানা ট্রলারযোগে হাবিবুর রহমানের আত্মীয় মো. খলিলুর রহমান ঢাকায় নিয়ে অসেন।
পরের দিন তৎকালীন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় লিড নিউজ ছিল- বাংলার মানুষ কাঁদো, ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে লাশ। এরপরই তোলপাড় শুরু হয় দেশব্যাপী। টনক নড়ে তৎকালীন সরকারের। ছুটে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তৎকালীন ছাত্রনেতা বর্তমান ভোলা-১ আসনের সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভোলা সদর, দৌলতখান, তজুমদ্দিন ও মনপুরা উপজেলায় গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করেন। ওই সময়ের পাক সরকার প্রধান না আসায় ক্ষোভ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু। ১৮ দিন পর আসেন সরকারপ্রধান।
১৯৭০ সালের পরবর্তী দুর্যোগকালে সাহসি ভূমিকা রাখায় এবার সিপিপি স্বেচ্ছাসেবকদের পুরস্কার ও সনদ তুলে দেন ঘূর্ণিঝড় ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শিখা সরকার। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন-দৌলতখানের মো. নেজামল হক, তজুমদ্দিনের অবিনাশ চন্দ্র দে, চরফ্যাশনের সাবের আহমেদ, লালমোহন উপজেলার মো. ঈমাম হোসেন, বোরহানউদ্দিনের মো. আবুল কালাম, মনপুরার দিলীপ কুমার মজুমদার ।