বাংলাদেশ ভারত সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলা। ক্ষুদ্র জাতী নৃগোষ্ঠির মানুষের বসবাস আছে এখানে। গারো পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড় ও সমতলের মিলনস্থল এই উপজেলার গামারীতলা ইউনিয়নের একটি গ্রাম কলসিন্দুর। সবুজ ফসলের মাঠ আর পাহাড়ের সীমানা প্রাচীর এখানকার প্রকৃতিকে করেছে দৃষ্টি নন্দন। অজপাড়া গাঁ বলতে যা বোঝায় তার থেকেও পিছিয়ে পড়া জনপদ এটি। তবে এখন দেশব্যাপি এই গ্রাম হয়ে উঠেছে সুপরিচিত। শিরোপাজয়ী নারী ফুটবল দলের আট সদস্যের বাড়ি এই কলসিন্দুরেই। তাদেরই একজন ক্ষুদ্র জাতী নৃগোষ্ঠির, মারিয়া মান্দা। বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত “নেতাই” নদীর পারে থাকে মারিয়া মান্দার পরিবার। ফুটবলের কল্যাণে মারিয়াকে সকলেই চেনে এখন। তবে কজনইবা জানে মারিয়া মান্দার জীবন সংগ্রামের কথা। না, রাতারাতি কোন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে মারিয়া সফল হয়নি। এই সফলতার পিছনের গল্প যেনো নাটক সিনেমাকেও হার মানায়।
কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সরু রাস্তায় পায়ে হেটে এক কিলোমিটার দূরে নেতাই নদীর ঘাট। হাঁটু জল নদী পায়ে হেটে পার হওয়া যায় আবার পানি বেশি থাকলে আছে খেয়া পারাপারের ব্যবস্থা। নদী পার হয়ে আরও দেড় কিলোমিটার পায়ে হাঁটার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পর মন্দির কোনা পাড়ায় মারিয়ার মায়ের টিনের ভাঙ্গাচোরা বাড়ি। যেনো একটু জোরে দমকা হাওয়া এলেই লুটিয়ে পড়তে পারে মাটিতে। ক্ষুদ্র জাতী নৃগোষ্ঠি মাতৃতান্ত্রীক পরিবার হওয়ায় মারিয়ার মা এনোতা মান্দা বীরেন্দ্র মারাককে বিয়ে করে নিজ বাড়িতে এনেছিলেন। মারিয়ার বয়স যখন তিন বছর তখন তার বাবা মারা যায়। ঘরে তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে জীবন সংগ্রামে নামে মারিয়ার মা এনোতা মান্দা। বন্ধ হয়ে যায় বড় মেয়ে হাসি মান্দার স্কুলে যাওয়া। মেঝো মেয়ে পাপিয়া মান্দা কোনদিনই স্কুলে যেতে পারেনি। সংসার চালাতে ঢাকায় গৃহপরিচারিকার কাজে দেয়া হয় হাসি মান্দা ও পাপিয়া মান্দাকে। ছোট ভাই ডানিয়াল মান্দা তখন মায়ের কোলে। নিজের কোন জমিজমা নেই। কিছু খাস জমি চাষাবাদ ও অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান মারিয়ার মা এনোতা মান্দা।
এদিকে চরম অভাব অনটনের সাথে লাড়াই করে বড় হতে থাকে মারিয়া মান্দা। মা ও বড়বোন মিলে তাকে ভর্তি করে দেয় কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তখন থেকেই খেলাধোলার দিকে ঝোক তার। “দৌড়” খেলায় ছিলো পারদর্শী। স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় মারিয়া অংশ নেয় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার দৌড় খেলায়। খেলায় অংশ নেয়ার সময় পরে গিয়ে এক হাত ভেঙ্গে যায় মারিয়ার। অভাবের পরিবার পাহাড়ি লতাপাতা দিয়ে শৈল চিকিৎসার মাধ্যমে মারিয়ার হাত ভালো করে তোলে। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের জন্য যখন কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী ফুটবল টিম গঠন করার কাজ শুরু করেন প্রধান শিক্ষক। তখন ডাক আসে দৌড়ে পারদর্শী মারিয়া মান্দার। এখান থেকেই শুরু নতুন যাত্রার।
কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল বলেন, মারিয়াকে যখন দলে নেয়া হয় তখন সে একেবারেই শিশু। সবে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তার বাড়ি একেবারেই প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় স্কুল ও খেলার অনুশীলনের জন্য যাওয়া আসার সমস্যাটা ছিলো বড়। তার বাবা নেই, ঘরে অভাব অনটন, ভাইটিও তার ছোট এঅবস্থায় খেলায় নেয়ার ক্ষেত্রে মারিয়ার মাকে অনেক বোঝাতে হয়েছে। মেয়ের আগ্রহ আর মায়ের পরিশ্রমে আজকের মারিয়া মান্দা। যাকে দেশের মানুষ চেনে। যার পরিচয়, সে আমার ছাত্রী নয় আমি তার শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। আজ প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলসিন্দুর স্কুলকে মারিয়া, সানজিদাদের জন্য চিনে।
তখন কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিরত ছিলেন মোঃ মফিজউদ্দিন। নারী ফুটবলারদের খেলা শেখা ও প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়ার দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
২০১৩ সালে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই টুর্নামেন্টটি খালি পায়ে খেলার সুযোগ ছিলো।
শিক্ষক মোঃ মফিজউদ্দিন বলেন যখন দেখলাম খালি পায়ে খেললে সামনে আরো বড় টুর্নামেন্ট খেলা সম্ভব হবেনা তখন বুট পরে খেলা শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া মারিয়ার ফুটবল খেলার বুট ছিলোনা। আমার কাছ থেকে দুই দিনের ছুটি নেয় সে। সেই দুই দিন অন্যের কৃষি জমিতে ধান রোপণের দিনমজুরের কাজ নেয় সে। মুজুরি পায় তিনশত টাকা। সেই টাকা দিয়ে আরেকজনের সহযোগীতায় কেনে ফুটবলের বুট জুতা। নতুন জুতা আমাকে যখন দেখাতে আনে তার মুখের আনন্দের হাসিটি এখনো আমার মনে আছে। আমি দেখলাম জুতা পরে লাফাত লাফাতে মাঠে নামলো সে। পরে যখন জানতে পেরেছি ফুটবলের বুট জুতা কেনার জন্য অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করেছে চতুর্থ শ্রেণীর এই ছোট্ট মেয়ে, তখন খারাপ লেগেছে। খেলার জন্য প্রয়োজন শক্তি, সেজন্য দরকার পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার। তখন প্রয়োজন ছিলো মারিয়ার জন্য উন্নত খাবার। কেউ এগিয়ে আসেনি, খালি পেট অর্ধ খালি পেটে খেলতে হয়েছে মারিয়াকে।
যে জনপদে ছিলো ধর্মীয় গোড়ামী ও বাল্য বিয়ের প্রচলন সেখানে মারিয়ার ফুটবল খেলার পথ মোটেই সহজ ছিলোনা। মারিয়ার বোন পাপিয়া মান্দা বলেন ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার কারণে আমাদের চরম কষ্টের মধ্যে পরতে হয়। সংসারে মা সহ আমরা পাচ জন। সকল দায়িত্ব মায়ের ঘারে পরে। আমাদের নিজের জমি বলতে শুধু বাড়ি ভিটা। তিন বেলা খাবার যোগাড় করাই আমাদের জন্য কষ্ট হয়ে যতো। বড় বোনের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে ঢাকায় কাজ করতে চলে যায়। মা অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে আমি মায়ের সাথে কাজে যোগ দেই। এরমধ্যে বড় বোনে বিয়ে করে চলে যায়। যখন দেখি এভাবে সংসার চলছে না, পরে আমিও ঢাকায় মানুষের বাসায় কাজ করতে চলে যাই। বছরে একবার আসতাম বাড়িতে ক্রিষ্টমাসের সময়। আমরা অনেক কষ্ট করেছি। মারিয়া আর আট দশটা মেয়ের মতো বড় হতে পারেনি। এখন এতো অল্প বয়েসে সংসারের হাল ধরেছে সে।
কথা হয় মারিয়ার বড় বোন হাসি মান্দার সাথে। বলেন প্রতিবেশিরা অনেকে কিছু বলেছে। এলাকায় মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রচলন নেই দেখে মারিয়াকে অন্য চোখে দেখতো। মেয়ে মানুষ ফুটবল খেলে কি হবে এসব বলতো। তখন আমি মারিয়াকে বড় বোন হিসাবে বলতাম খেলতেছ খেলো মানুষের কথায় কোন কান দিবে না। আমি বোনকে উৎসাহ দিতাম। শুরুতে প্রতিবেশিরা যারা মারিয়াকে টিটকারি টিপ্পনি করতো তারাই এখন উৎসাহ দেয়, মারিয়া ভালো খেললে উল্লাস করে। এটা দেখে আমার খুব ভালো লাগে।
এলাকার বাসিন্দা মধুসুদন সকার বলেন মেয়েরা হাফপেন্ট পরে ফুটবল খেলবে এটাতো একটা আজব ঘটনা। গ্রামের অনেকেই এটি সহজ ভাবে নেয়নি। কিন্তু এখন এক সময়ের টিটকারি টিপ্পনি কাটা লোকটিও চায়ের দোকানে অন্যদের সাথে টেলিভিশনে খেলা দেখে উল্লাস করে।
মারিয়ার মামা জেফ সাংমা বলেন মারিয়ারা আগে একটি কুঁড়ে ঘরে থাকতো। তাদের অসহায় অবস্থা দেখে ২০০৮ সালে কারিতাস নামে এক এনজিও একটি টিনের ঘর করে দেয়। ভঙ্গুর এই টিনের ঘরেই এখন তাদের বসবাস। মারিয়া অভাব অনটনের মাঝেও অনুশলীন বাদ দেয়নি। বর্ষায় যখন নদীতে পানি বেশি হয়ে যেতো তখন অনেক সময় সাঁতরে নদী পার হয়ে স্কুল মাঠে গেছে। খেলা তার জীবনের সব। তিনি জানান সম্প্রতি দুই কাঠা জমির মালিক হয়েছে মারিয়ার মা। আর কিছু খাস জমিতে নিজেই ধান চাষ করে চলছে সংসার।
মারিয়া জেলা পর্যায়ের ডিএফএ টুর্নামেন্টে নজরে আসে বাফুফে কর্মকর্তাদের। ডাক পড়ে অনুর্দ্ধ-১৪ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলার জন্য। মারিয়া পাড়ি জমায় ঢাকায়। ২০১৪ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব -১৪ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে মারিয়া মান্দা ভাল খেলে। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। পরের বছরই তাজিকিস্তানে অনূর্ধ্ব -১৪ টুর্নামেন্টে অংশ নেয় মারিয়া। সেখানেও ভাল পারফরমেন্স। এবারও চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। মারিয়া পালন করে সহ অধিনায়কের দায়িত্ব।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এএ্ফসি অনূর্ধ্ব -১৬ টুর্নামেন্টের বাছাই পর্বের খেলায়ও ছিলো মারিয়ার আদিপত্য।
অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের অধিনায়কের দায়িত্ব পায় মারিয়া। অত্যন্ত দক্ষতা আর নিজের নিখুঁত ফুটবল খেলা দিয়ে বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব। পরিবর্তন শুরু হয় বাংলাদেশের নারী ফুটবল খেলার। এরপরের গল্পটা তো পুরো বাংলাদেশ দেখল।